জাতীয়দুর্নীতিবাংলাদেশসংগৃহীত সংবাদ

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দুর্নীতি তদন্তে গুরুতর প্রশ্ন

তথ্য আড়াল ও ‘এজেন্ডাভিত্তিক’ প্রতিবেদন তৈরির অভিযোগ

বিশেষ প্রতিনিধি: ইসলামিক ফাউন্ডেশনে (ইফা) বিগত সরকারের সময়ে সংঘটিত কথিত অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কার্যক্রম নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তদন্ত প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তা অবলম্বন, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আড়াল করা এবং অভ্যন্তরীণ প্রভাব খাটানোর জোরালো অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে, ফাউন্ডেশনের অতীতের বড় বড় নিয়োগ ও পদোন্নতিতে সংঘটিত গুরুতর অনিয়মের বিষয়গুলো তদন্তের আওতায় থাকা সত্ত্বেও, অনেক ক্ষেত্রেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আলোচিত ও প্রভাবশালী একটি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি তদন্ত কেন অসম্পূর্ণ থাকছে এবং কেন তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে—এ নিয়ে প্রশাসনিক মহলেও ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।

বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন ও রদবদল

২০২৫ সালের ১৪ মে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আগারগাঁও কার্যালয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে হওয়া দুর্নীতি তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠিত হয়। শুরুতে কমিটির সদস্যরা ছিলেন:

  • সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর (অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগ) – আহ্বায়ক
  • মোঃ সাখাওয়াত হোসেন (তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়) – সদস্য
  • মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন (তৎকালীন সচিব/যুগ্ম সচিব, ইফা) – সদস্য-সচিব

পরবর্তী প্রশাসনিক রদবদলে কমিটির কাঠামো পরিবর্তন হয়:

  • ০২ জুন ২০২৫: সদস্য সাখাওয়াত হোসেন কৃষি মন্ত্রণালয়ে বদলি হলে তার স্থলাভিষিক্ত হন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফজলুর রহমান
  • ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫: কমিটির সদস্য-সচিব ইসমাইল হোসেন তদন্ত কার্যক্রমে ‘অনিয়ম হচ্ছে’ উল্লেখ করে dissent note জমা দেন এবং নৌ মন্ত্রণালয়ে বদলি হন।
  • ২২ সেপ্টেম্বর: ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নতুন সচিব শেখ মুর্শিদুল ইসলাম (উপসচিব) সদস্য-সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
  • পরবর্তীতে বোর্ড অব গভর্নরসের সিদ্ধান্তে কমিটির সঙ্গে আরও দুই বিশিষ্ট আলেম—মুফতি মাহফুজুল হক ও ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদনী—যুক্ত হন।

তদন্তে ‘ওভাররাইট’ ও ‘গোপন এজেন্ডা’র অভিযোগ

তদন্তের কাজে সহায়তা করার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এক প্রকাশনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তথ্য পরিবর্তন, রিপোর্টে প্রভাব বিস্তার এবং ‘এজেন্ডা অনুযায়ী প্রতিবেদন’ তৈরির অভিযোগ উঠেছে। ওই কর্মকর্তা হলেন শেখ নাসির (মোবাইল: ০১৭৯৮-৫৯৪৯০৩)।

অভিযোগকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন, যে কর্মকর্তার নিজের নিয়োগই নিয়োগবিধি উপেক্ষা করে কোনো সিলেকশন কমিটির সভা ছাড়াই অবৈধভাবে হয়েছিল, তাকেই কেন তদন্ত সহায়তার দায়িত্ব দেওয়া হলো?

এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে, প্রতিবেদনে এমন কিছু নাম যুক্ত করার চেষ্টা চলছে, যাদের বিরুদ্ধে হয়তো শক্ত অভিযোগের ভিত্তি নেই; অথচ যাদের বিরুদ্ধে সরকারি নথিপত্রে স্পষ্ট অনিয়ম নথিভুক্ত ছিল, তাদের অনেককেই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

তদন্তের বাইরে থাকা বড় অনিয়মগুলো

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ফাউন্ডেশনের সবচেয়ে বড় ও আলোচিত কিছু অনিয়ম তদন্তের আওতায় এলেও সেগুলোর প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে:

  • অনুমোদনবিহীন পদে নিয়োগ: সহকারী পরিচালক পদে অনুমোদিত ছিল মাত্র একটি পদ, কিন্তু সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয় দুইজন—মোঃ মহিউদ্দিন মাহিন ও মোঃ আব্দুল হামিদ খান-কে। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক পরিচালক (অর্থ) তার ভাইয়ের মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে আব্দুল হামিদকে চাকরি দেন। এই গুরুতর অনিয়মের কোনো তদন্ত প্রতিবেদন আসেনি।
  • অনুমোদনের অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ: প্রোগ্রাম অফিসার পদে ৪টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ৭ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলস্বরূপ ৩ জন অতিরিক্ত নিয়োগ পান (আমেনা বেগম, আবুল কাশেম, মাকসুদুর রহমান, আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, হুমায়ুন কবির, মোঃ নিজাম উদ্দিন প্রমুখ)। এ নিয়েও কোনো প্রতিবেদন নেই।
  • বড় পদোন্নতিতে দুর্নীতি: ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সহকারী পরিচালক থেকে উপপরিচালক, হিসাবরক্ষক থেকে সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক থেকে পরিচালক পদে প্রতিযোগিতা, মেধা এবং নীতিমালা উপেক্ষা করে পদোন্নতি ও নিয়োগ বাণিজ্য সংঘটিত হয়। কোনোটিরই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি।
  • দারুল আরকাম ও মসজিদভিত্তিক শিক্ষা প্রকল্প: এই দুটি বড় প্রকল্পে ১০১০টি মাদ্রাসা ও শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ২০১২, ২০১৫ ও ২০২০ সালের তিন দফা ঘাটতি তদন্তের বিষয়ে কোনো রিপোর্ট আসেনি। এমনকি ২০২২ সালে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের দায়িত্বশীল অতিরিক্ত সচিব নায়েব আলী মণ্ডলের সময়েও নিয়োগে ব্যাপক অভিযোগ উঠলেও তদন্তের ফলাফল আসেনি।

কমিটির অভ্যন্তরে অন্তর্দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত

কমিটির সদস্য-সচিব ইসমাইল হোসেনের dissent note জমা দেওয়া এবং পরবর্তীতে তার বদলি হওয়াকে পর্যবেক্ষকরা ‘তদন্তে প্রভাব খাটানোর জোরালো ইঙ্গিত’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। তারা বলছেন, কমিটির সদস্য বদল তদন্তের স্বাধীনতায় প্রভাব ফেলতে পারে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, “যদি তদন্ত তথ্য বাস্তবভাবে প্রকাশ পেত, তাহলে বড় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও শীর্ষ প্রশাসনও এর মুখোমুখি হতো।” সরকারি প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় দুর্নীতি চক্রের মানুষ এখনও সক্রিয় এবং ‘ম্যানিপুলেটেড ক্লিনচিট’ দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

ভাবমূর্তি সংকটে ইফা: জরুরি প্রশ্নসমূহ

দেশের অন্যতম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিশাল বাজেট (মসজিদভিত্তিক শিক্ষা প্রকল্প, হালাল সার্টিফিকেশন, প্রকাশনা কেন্দ্র ইত্যাদি) এবং ভাবমূর্তি রক্ষায় তদন্তের স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন সামনে আসা মূল প্রশ্নগুলো হলো:

১. কেন বড় বড় অনিয়ম তদন্তের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেল?
২. কীভাবে অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি তদন্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলো?
৩. যারা প্রকৃত দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, তারা কেন ‘অদৃশ্য সুরক্ষা’ পেল?
৪. Dissent note জমা দেওয়ার পরও তদন্ত কাঠামো কেন বদলানো হলো না?
৫. তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হবে কি? হলে কবে?

একসময় দুর্নীতি উন্মোচন ও দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার বড় প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হওয়া এই তদন্ত এখন রাজনৈতিক স্বার্থ, প্রশাসনিক চাপ ও গোষ্ঠীগত সুরক্ষার অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ। দেশবাসী এখন স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্তের অপেক্ষায়, যা প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখতে পারে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button