দুর্নীতির ফলে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ২৫ শতাংশ

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক, আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশে বিদ্যুৎ খাতে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে জাতীয় কমিটি। কমিটির দাবি, এই দুর্নীতির প্রভাবেই দেশে বিদ্যুতের দাম কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি ও অর্থ পরিশোধের মধ্যে যে বিশাল অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে, তা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও মেলাতে পারবেন না।
গতকাল রবিবার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংক্রান্ত চুক্তিগুলো পর্যালোচনার জন্য গঠিত জাতীয় কমিটির সদস্যরা এই মন্তব্য করেন।
বিগত সরকারের আমলে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)’–এর অধীনে প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছিল। দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই আইনটি বাতিলের দাবি উঠলেও তা গ্রাহ্য করা হয়নি। তবে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আইনটি বাতিল করে এবং একই আইনের আওতায় হওয়া চুক্তিগুলো পর্যালোচনার জন্য গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটি তাদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনটি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের হাতে তুলে দেয়। কমিটির সদস্যরা জানান, তারা আগামী বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারবেন।
প্রতিবেদন গ্রহণ করে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, একটি নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র প্রতিবেদন তৈরির উদ্দেশ্যে সরকারের বাইরের বিশিষ্টজনদের দিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে, যাতে কোনো প্রশ্নের উদ্রেক না হয়। তিনি কমিটির সদস্যদের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই বলেও মন্তব্য করেন।
আদানির চুক্তিতে কোনো অনিয়ম প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আদানির চুক্তিতে যদি কোনো রকম অনিয়ম পাওয়া যায়, তবে তা বাতিল করতে সরকার দ্বিধা করবে না। তবে আদালত মুখের কথা মানবে না, তাই যথাযথ কারণ থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, কোনো চুক্তি সাধারণত দুটি কারণে বাতিল করা যায়—একটি কারণ ছাড়া, অন্যটি কারণসহ। কারণ ছাড়া বাতিল করলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ (এলডি বা লিকুইডেটেড ড্যামেজ) দিতে হবে। এমনিতেই সরকার অনেক আর্থিক দায় বহন করছে, নতুন করে আর দায় বাড়াতে চান না তিনি।
আমলাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেই প্রসঙ্গে ফাওজুল কবির খান জানান, সবার সহযোগিতা পেলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সব তথ্য দুদকের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার মতো তেমন কিছু নেই, কারণ অভিযুক্তদের অনেকেই ইতোমধ্যে চাকরি ছেড়েছেন।
অন্যদিকে, চুক্তি বাতিল প্রসঙ্গে জাতীয় কমিটির সদস্য আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, চুক্তি বাতিলের যথেষ্ট কারণ থাকলেও, বাতিল করলে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে এবং ৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, বাতিল না করলে এখন যে ক্ষতি হচ্ছে, ভবিষ্যতে তার চেয়ে দশ-বিশ গুণ বেশি গচ্চা যেতে পারে।
কমিটির অন্য সদস্যরা বলেন, আদানির চুক্তি বাতিল করার পর যদি মামলায় জেতার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে অবশ্যই বাতিলের সুপারিশ করা হবে। তারা মনে করেন, আইনি লড়াইয়ে জেতার সম্ভাবনা ৩০ শতাংশের কম হলে আদালতে যাওয়া হবে না। তবে ৮০ শতাংশ জয়ের সম্ভাবনা থাকলে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হবে। তবে সব তথ্য আগেভাগে প্রকাশ করলে ক্ষতি হতে পারে বলে তারা এখন সব কথা বলতে রাজি হননি।
জাতীয় কমিটির প্রধান, সাবেক বিচারপতি মইনুল ইসলাম, বলেন, বিগত সরকারের আমলে দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ আইনের সুযোগ নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে। তিনি জানান, ভারতের আদানি-সহ যেসব দেশি-বিদেশি কোম্পানি এই কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
কমিটির আরেক সদস্য, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ‘ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস’-এর অধ্যাপক (অর্থনীতি) মোশতাক হোসেন খান বলেন, এই চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি কোম্পানির চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। যদি কারচুপির প্রমাণ মেলে, তবে ইচ্ছামতো বাতিল করা যায় না, বাতিল করলে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে বড় অঙ্কের জরিমানা আসতে পারে। এজন্যই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রক্রিয়াগুলো দেখতে সময় লেগেছে। তিনি জানান, অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে সব বিষয় প্রকাশ করা হয়নি, কারণ কিছু কিছু বিষয় এখনও চলমান।
অধ্যাপক মোশতাক হোসেন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “আপনারা আগামী মাসখানেকের মধ্যে দুর্নীতির শক্ত প্রমাণ পাবেন। এখানে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, এই দুর্নীতি আমাদের রোধ করতেই হবে। এটাকে মেনে নেওয়া বা সহ্য করা সম্ভব নয়।” তিনি হিসাব দেন যে এই দুর্নীতির কারণে ইতোমধ্যে দেশের বিদ্যুতের দাম প্রতিযোগীদের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে, ভর্তুকি সরিয়ে দিলে যা ৪০ শতাংশ হবে। এই দামে দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান টিকতে পারবে না বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিবেদনে আছে কোথায় কোথায় ভুলগুলো করা হয়েছে। যেখানে ওপর থেকে হুকুম এসেছে, ইন্টারভেনশন করা হয়েছে। প্রশাসন সবসময় নির্দোষ ছিল তাও না, সেটারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মাশুলটা দিচ্ছে সাধারণ ভোক্তা, ক্রেতা ও করদাতারা। আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তারা চলে গেছে। আমরা প্রমাণ সংগ্রহ করছি, অ্যাকশন নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে যাতে এটা আর না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এটি অনেক কঠিন কাজ, তাড়াহুড়ো করলে ভুল হতে পারে।”
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন চারগুণ বাড়লেও অর্থ পরিশোধ বেড়েছে ১১ দশমিক ১ গুণ। ২০১১ সালে বিদ্যুতের জন্য যেখানে ৬৩৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল, ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, বিশেষ বিধান আইনে বারবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এবং বারবার দায়মুক্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু এই মন্ত্রণালয় সবসময় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ছিল, তাই প্রধানমন্ত্রীর অফিস এবং অন্যান্য ক্ষেত্র মিলে সেখানেও একটি সমস্যা রয়েছে।



