মানুষে-মানুষে মিল-মহব্বতের রহস্য: হাদিসের আলোকে ‘রূহের জগতে পরিচিতি’ তত্ত্ব
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: মানুষের পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও মিল-মহব্বতের নেপথ্যে কি কোনো আধ্যাত্মিক কারণ রয়েছে? রূহের জগতে পূর্ব-পরিচিতিই কি দুনিয়ার প্রীতির বন্ধন তৈরি করে? ইসলামি জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে এমন একটি প্রশ্ন প্রায়শই উত্থাপিত হয়ে থাকে। জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টারের দাঈ, আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি, এই বিষয়ে একটি সহিহ হাদিস ও তার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন।
প্রশ্ন: রূহসমূহ পৃথিবীতে আসার আগে একসঙ্গে ছিল, এবং তাদের মধ্যেকার সেই পরিচিতি ও সম্পর্কের কারণেই দুনিয়াতে আমাদের মধ্যে মিল-মহব্বত তৈরি হয়—এমন একটি বিষয় শোনা যায়। এটি কি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে? এর সত্যতা কতটুকু?
উত্তর: উত্তর প্রদানকারী দাঈ, আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি, এই প্রসঙ্গে সহিহ মুসলিমের একটি হাদিস তুলে ধরেছেন:
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“ الأَرْوَاحُ جُنُودٌ مُجَنَّدَةٌ فَمَا تَعَارَفَ مِنْهَا ائْتَلَفَ وَمَا تَنَاكَرَ مِنْهَا اخْتَلَفَ”
অর্থাৎ: “রূহসমূহ সৈনিকদের মতো সংঘবদ্ধ (marshaled hosts) ছিল। সুতরাং যারা পরস্পরে পরিচিতি লাভ করেছে তারা দুনিয়াতে পরস্পরে প্রীতি বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আর যারা সেখানে অপরিচিত তারা এখানেও ভিন্ন থাকে।”
(সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার, অনুচ্ছেদ: রূহসমূহ সমাজবদ্ধ)
১. স্বভাবগত মিল: ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, পৃথিবীতে আসার আগে রূহগুলো সমাজবদ্ধ ও বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। পরবর্তীতে এগুলোকে বিভিন্ন দেহে স্থাপন করা হয়েছে। যার স্বভাবের সাথে রূহের জগতের অন্য কোনো রূহের মিল ছিল, দুনিয়াতে এসে সে তাকেই ভালোবাসে। পক্ষান্তরে, স্বভাবের অমিল থাকলে তাদের মধ্যে ভিন্নতা বা দূরত্ব বজায় থাকে।
২. কল্যাণ-অকল্যাণের সাদৃশ্য: ইমাম খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা প্রদান করে বলেন, মানুষের রূহগুলো কল্যাণ-অকল্যাণের দিক থেকে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। তাদের পরস্পরের পরিচিতি সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেই হয়েছিল। যখন দুটি রূহ একই বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়, তখন তারা পরস্পর পরিচিত হয়ে প্রীতি লাভ করে। আর বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হলে তারা অপরিচিত থেকে যায়।
৩. সৃষ্টির সূচনা: আরেকটি ব্যাখ্যার সম্ভাবনা হলো, এই হাদিসে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কর্তৃক সৃষ্টিকুলের প্রাথমিক সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, যখন রূহকে শরীরের আগে সৃষ্টি করা হয়েছিল। রূহগুলো শরীরে প্রবেশের পরই পরিচিতি লাভ করে। কেউ কেউ বলেছেন, প্রথম সৃষ্টির সময়ই রূহসমূহকে দুই প্রকারে সৃষ্টি করা হয়েছিল। (‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খণ্ড, হা/ ৪৮২)
মুসনাদে আবি ইয়ালাতে বর্ণিত একটি ঘটনা এই হাদিসের সত্যতা সমর্থন করে। উমরাহ বিনতে আব্দুর রহমান (রা.) থেকে বর্ণিত, মক্কায় একজন খুব রসিক (কৌতুক কারী) মহিলা ছিলেন। তিনি মদিনায় হিজরত করে গেলে সেখানকার অনুরূপ বৈশিষ্ট্যের আরেকজন মহিলার নিকট থাকার স্থান পান। এই সংবাদ শুনে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বলেন, “আমার প্রিয়তম সত্যই বলেছেন। আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি:…(তারপর তিনি উপরোক্ত হাদিসটি পেশ করেন)।”
এভাবে হাদিস ও তার ব্যাখ্যা প্রমাণ করে যে, মানুষের পারস্পরিক আকর্ষণ বা বিদ্বেষ মূলত রূহের জগতে তাদের পূর্ব পরিচিতি বা স্বভাবের সাদৃশ্যের ফল।



