ইসলাম ধর্ম

কারবালার ঐতিহাসিক লড়াই: আশুরার সকালে সত্যের পথে হোসাইন (রাঃ)-এর আত্মত্যাগ ও দুই পুত্রের শাহাদাত

ইসলামিক ডেস্ক: কারবালার মরুভূমিতে আশুরার ভোরে নেমে আসে এক নিদারুণ নীরবতা। একদিকে তীব্র গরমের উত্তাপ, অন্যদিকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে শেষ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) ও তাঁর ক্ষুদ্র কাফেলা। সেখানে ছোট শিশুদের কান্নার করুণ সুর, নারীদের অসীম ধৈর্য এবং মুষ্টিমেয় সৈন্যদের দৃঢ় সংকল্প এক ঐতিহাসিক পরিবেশ সৃষ্টি করে।

যুদ্ধের প্রাক্কালে হোসাইন (রাঃ) ঘোড়ায় আরোহণ করে ইয়াজিদের বিশাল বাহিনীর উদ্দেশে এক মর্মস্পর্শী ঘোষণা দেন। তিনি বলেন:

“হে মুহাম্মদ ﷺ-এর উম্মাহ, আমি শুধু সংস্কারের (ইসলা’হ) জন্যই বের হয়েছি।” (উচ্চারণ: ইয়া উম্মাতা মুহাম্মাদ, ইন্নি লাম আখরুজ ইল্লা লিত্বালাবিল ইসলা’হ)।

তাঁর কণ্ঠস্বর মরুভূমির মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে সত্যের সিংহাসনকে অটল রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। তিনি আরও ঘোষণা দেন:

“আমি শুধু সত্যের পক্ষে, এবং যে আমাকে হত্যা করবে, সত্য কখনো হারবে না।” (উচ্চারণ: ইন্নামা আনা আলাল-হাক্কি, ওয়ামান কাতালানী ফালান ইয়াহলিকাল-হাক্কু)।

⚔ সংগ্রামের সূচনা ও সহচরদের শাহাদাত

ইয়াজিদের সেনাবাহিনী যখন আক্রমণ শুরু করে, তখন হোসাইন (রাঃ)-এর সৈন্যরা একের পর এক সাহসের সাথে এগিয়ে যান এবং শাহাদাত বরণ করেন। হাবিব ইবনে মাযাহির, মুসলিম ইবনে আওসাজা, জুন এবং নাফে-এর মতো নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গীরা একে একে জীবন উৎসর্গ করেন। প্রতিটি আত্মদানের পর হোসাইন (রাঃ) মৃদু দোয়া পাঠ করতেন:

“হে আল্লাহ, তাদের রক্ত যেন মুহাম্মদ ﷺ-এর উম্মাহর জন্য স্নেহ ও শিক্ষা হয়।” (উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা জ‘ল দামাহুম শিফা লি উম্মাতি মুহাম্মাদ)।

🌟 আলী আকবরের বীরত্ব ও শাহাদাত

এই কঠিন সময়ে হোসাইন (রাঃ)-এর প্রিয় পুত্র আলী আকবর (১৮ বছর বয়সী) যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যান। নবীর চেহারার সাথে তাঁর সাদৃশ্য দেখে শত্রুরাও ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়। অদম্য সাহস নিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন, কিন্তু শত্রুর আঘাতে তিনি শহীদ হন। পুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হোসাইন (রাঃ) দোয়া করেন:

“হে আল্লাহ, আমার সন্তানকে শহীদ হিসেবে গ্রহণ কর।” (উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা জ‘ল ইবনিকে মিনাশ-শহাদা)।

🌾 ছয় মাসের শিশু আলী আসগরের করুণ পরিণতি

এরপর কারবালার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক মুহূর্তটি আসে। হোসাইন (রাঃ)-এর ছয় মাসের শিশু আলী আসগর (রাঃ) মা রাবাব (রাহ.)-এর কোলে তীব্র তৃষ্ণায় ছটফট করছিল। হোসাইন (রাঃ) শিশুটিকে আকাশের দিকে তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন:

“হে আল্লাহ, শিশুকে শহীদ কর এবং আমাদের হৃদয় দৃঢ় কর।” (উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা জ‘লহু শাহীদা ও থাব্বিত কুলুবানা)।

ঠিক তখনই এক শত্রুর নিক্ষিপ্ত তীরে শিশুটি শহীদ হয়। মায়ের কোলের এই নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যু কারবালার শোককে গভীরতম পর্যায়ে নিয়ে যায়।

⭐ হোসাইন (রাঃ)-এর অদম্য দৃঢ়তা

যখন তাঁর সকল সঙ্গী ও পুত্র শহীদ হন, তখন হোসাইন (রাঃ) একাকী দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি জানতেন, সত্যের পথে মৃত্যুই সর্বোচ্চ সম্মান। অটল বিশ্বাসে তিনি শত্রুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এই প্রত্যয় নিয়ে যে:

“সত্য নিজের পথ শেষ করবে, কেউ তা ধ্বংস করতে পারবে না।” (উচ্চারণ: সাইউদ্দিল হাক্কু দওরাহু ওয়ালা ইয়াহলিকুহু আহদুন)।

এই চরম পরিস্থিতিতেও হযরত যয়নাব (রাহ.) নারীদের সংগঠিত করে ধৈর্য ও সাহসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্ষণিকের জন্য ধৈর্য ধরছি, মৃত্যুকে সম্মান মনে করি। হোসাইন (রাঃ) আমাদের নায়ক, আমরা তাঁর পথকে হারাবো না।’ নারী ও শিশুদের এই ধৈর্য কারবালার এক অমর শিক্ষাকে আজও ধারণ করে আছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button