অপরাধদেশপ্রতারনাবাংলাদেশসম্পাদকীয়

দেশের ধনীদেরও ঠকাচ্ছে অনিক-সোহেলের ভুয়া ‘প্রাচীন পিলার’ চক্র: ফাইভস্টার হোটেলে চলতো প্রতারণা

নিজস্ব প্রতিবেদক: সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরাও শিকার হচ্ছেন এক অভিনব প্রতারণার। অনিক ও সোহেল নামের দুই ব্যক্তির নেতৃত্বে এই চক্রটি ভুয়া ‘প্রাচীন পিলার ও কয়েন’ বিক্রির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, তাদের প্রতারণার কৌশল এতটাই সুচিন্তিত ও পেশাদার ছিল যে ভুক্তভোগীরা সহজে সন্দেহ করতে পারেননি।

ভুক্তভোগীদের বিবরণ অনুযায়ী, প্রতারক অনিক ও সোহেল সাধারণ কয়েন, পাথর অথবা সিলিন্ডার আকৃতির বস্তুকে কৃত্রিমভাবে পুরাতন বানিয়ে সেগুলোকে ‘প্রাচীন ও বিরল’ বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করতেন। কৃত্রিমভাবে দাগ ও চিহ্ন তৈরি করে সেগুলোতে ইতিহাসভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে ‘বিশেষ বিনিয়োগ’ হিসেবে বিক্রি করা হতো। এক ভুক্তভোগী (ছদ্মনাম রূপা) জানান, “ওরা বলেছিল পিলারটি প্রাচীন মন্দিরের অংশ। আমরা ছবি ও ইতিহাস দেখে বিশ্বাস করেছিলাম। পরে বুঝলাম এটি কৃত্রিম। আমাদের সব অর্থ হারাতে হলো।” অন্য এক ভুক্তভোগী ফরহাদ বলেন, “কয়েনগুলো ‘রেয়ার’ বলে চাপ দেওয়া হয়েছিল। লেনদেনের পর মেটাল টেস্টে বোঝা গেল সব ভুয়া।”

চক্রটি তাদের প্রতারণার ‘অপারেশন’ পরিচালনার জন্য ফাইভস্টার হোটেলের বিলাসবহুল লাউঞ্জ, কনফারেন্স রুম এবং রেস্তোরাঁ ব্যবহার করত। এই বিলাসবহুল পরিবেশ, সজ্জা এবং তাদের পেশাদারী প্রেজেন্টেশন ভুক্তভোগীদের মনে দ্রুত আস্থা তৈরি করত, ফলে ক্রেতারা বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনে দ্রুত ঝুঁকতেন।

এই চক্রের মূল কৌশল ছিল দেশের ধনী ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের টার্গেট করা। তারা নিজেদেরকে ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ পেশাদার হিসেবে উপস্থাপন করত। প্রাথমিক অভিযোগ অনুযায়ী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা এবং রাজশাহী শহর মিলিয়ে দেশের শতাধিক ব্যক্তি এই চক্রের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৫০-৭০ জন সাধারণ মানুষ, ২০-৩০ জন বৃহৎ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এবং ১০-২০ জন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি রয়েছেন। লেনদেনের পর প্রতারকেরা কখনও অর্ধেক বস্তু, কখনও ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বা সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করত।

ভুক্তভোগীরা লেনদেনের রশিদ, ব্যাংক ট্রান্সফারের প্রমাণ, ফেসবুক/মেসেঞ্জারে কথোপকথনের স্ক্রিনশট এবং প্রদর্শিত বস্তুর নমুনা সংগ্রহ করেছেন। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বস্তুগুলো পরীক্ষা করার জন্য মেটাল কমপজিশন টেস্ট, স্ট্রাকচারাল বিশ্লেষণ এবং প্যাটিনা পরীক্ষা অত্যাবশ্যক। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, ‘প্রাচীন বস্তু যাচাই করার জন্য শুধু চেহারা বা ইতিহাসভিত্তিক ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। ল্যাবরেটরি টেস্ট এবং প্রমাণভিত্তিক যাচাই প্রয়োজন।’

আইনগতভাবে এটি প্রতারণা, জাল বিক্রয় এবং প্রতারণামূলক ব্যবসায়িক কৌশলের আওতায় পড়ে। ভুক্তভোগীরা থানায় এফআইআর দায়ের করে এবং প্রমাণাদি জমা দিয়ে মামলা করতে পারেন। এই চক্রের দ্রুত তদন্ত ও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেশের ধন্যাঢ্য ব্যক্তিদের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। একই সাথে জনগণের মধ্যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা এবং পেশাদারী যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button