পরিবেশপ্রযুক্তিপ্রাকৃতিক দুর্যোগবিজ্ঞানবিশ্লেষণ

নরসিংদীতে ভূমিকম্পের নেপথ্যে ‘লুকানো ফল্টলাইন’: বড় দুর্যোগের অশনিসংকেত?

নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্প্রতি সংঘটিত ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বা ‘এপিসেন্টার’ হিসেবে নরসিংদীর মাধবদীকে শনাক্ত করার পর জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সাধারণত সিলেট বা চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ভূমিকম্পপ্রবণ বলে মনে করা হলেও, নরসিংদীর মতো এলাকায় কম্পনের কেন্দ্রস্থল হওয়ায় অনেকেই বিস্মিত। তবে ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি ভূতাত্ত্বিক কারণ।

নোয়াখালী-সিলেট ফল্টলাইনের প্রভাব: বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে যে বিশাল টেকটোনিক ফল্ট রয়েছে, তার একটি সক্রিয় কিন্তু ‘লুকানো শাখা’ নরসিংদী পর্যন্ত বিস্তৃত। ভূগর্ভের এই শাখার নিচে দীর্ঘ দিন ধরে টেকটোনিক চাপ বা শক্তি জমা হচ্ছিল। সেই জমানো শক্তি হঠাৎ মুক্ত হওয়ার ফলেই নরসিংদীতে এই কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে।

ইনট্রা-প্লেট ভূমিকম্প: এই ভূমিকম্পটি ছিল মূলত ‘ইনট্রা-প্লেট’ (Intra-plate) ধরনের। অর্থাৎ, এটি দুটি বড় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে বা বাউন্ডারিতে ঘটেনি, বরং প্লেটের ভেতরের কোনো ফাটল বা দুর্বল স্থানে সংঘটিত হয়েছে। ‘ইন্দো-বার্মা টেকটোনিক’ অঞ্চলের প্রভাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সব সময়ই এক ধরনের চাপ থাকে। সেই চাপের ফলেই প্লেটের ভেতরের দুর্বল অংশ নড়ে উঠেছে।

অগভীর উৎপত্তিস্থল: রিখটার স্কেলে মাত্রা মাঝারি হলেও কম্পনটি তীব্র অনুভূত হওয়ার অন্যতম কারণ এর গভীরতা। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে। ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বলে, উৎপত্তিস্থল যত অগভীর হয়, কম্পনের তীব্রতা তত বেশি হয় এবং তা দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একারণেই ঢাকা, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত কম্পনটি প্রবলভাবে অনুভূত হয়েছে।

মধ্য-বাংলাদেশে অজানা সক্রিয় ফল্ট: এতদিন সাধারণ ধারণা ছিল, ভূমিকম্পের ঝুঁকি কেবল সিলেট, চট্টগ্রাম বা টেকনাফ সীমান্তেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু নরসিংদীর এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, ঢাকাসহ দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলেও (Central Bangladesh) অনেক অচিহ্নিত বা অজানা সক্রিয় ফল্টলাইন রয়েছে। সাম্প্রতিক কম্পনটি সেই সুপ্ত ফাটলগুলোর সক্রিয়তাই প্রকাশ করেছে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা: ভূতত্ত্ববিদরা এই ঘটনাকে বড় ধরনের ‘ওয়ার্নিং সাইন’ বা সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন। তাঁদের মতে, ঢাকা-গাজীপুর-নরসিংদী বেল্টে দীর্ঘ সময় ধরে ভূ-তাত্ত্বিক চাপ জমা হচ্ছে। নরসিংদী কেন্দ্রস্থল হওয়ার অর্থ হলো, পুরো এলাকাটিই ‘সিসমিক’ বা কম্পনজনিত দুর্বলতার মধ্যে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে বা গুজবে কান না দিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য মেনে চলা জরুরি। সেই সঙ্গে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সতর্কতা অবলম্বনই জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button