বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক: আমাদের এই পৃথিবী বাইরে থেকে দেখতে শান্ত ও সুজলা মনে হলেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক উত্তপ্ত ও রহস্যময় জগত। বিজ্ঞানের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত গভীরতা প্রায় ১২,৭৪২ কিলোমিটার। অথচ মহাকাশ জয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেলেও, নিজ গ্রহের মাটির নিচে মানুষ খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। মানবজাতি এখন পর্যন্ত মাটির গভীরে সর্বোচ্চ ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। আর এই দুঃসাহসী প্রচেষ্টার নাম—‘কোলা সুপারডিপ বোরহোল’।
১৯৭০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) নরওয়ে সীমান্তের কাছে কোলা উপদ্বীপে এই উচ্চাভিলাষী খনন প্রকল্পটি শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর একেবারে কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত পৌঁছানো। দীর্ঘ ২২ বছরের প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানীরা মাটির নিচে ১২ কিলোমিটার গভীর একটি গর্ত খুঁড়তে সক্ষম হন। এটিই এখন পর্যন্ত মানুষের তৈরি পৃথিবীর গভীরতম গর্ত।
তবে ১৯৯২ সালে এই প্রকল্প হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মূল কারণ ছিল ভূগর্ভস্থ অসহনীয় তাপমাত্রা। ১২ কিলোমিটার গভীরে তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এই প্রচণ্ড তাপে ড্রিল মেশিনগুলো গলে যেতে শুরু করে, ফলে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে আর সামনে এগোনো সম্ভব হয়নি।
বিজ্ঞানীরা জানান, এই ১২ কিলোমিটার ছিল কেবল পৃথিবীর ওপরের আবরণ বা ‘ক্রাস্ট’-এর অংশ। এর নিচেই রয়েছে ‘ম্যান্টল’, যেখানে পাথর গলে লাভা হয়ে ফুটছে। তার নিচে রয়েছে ‘আউটার কোর’—যা মূলত তরল লোহা ও নিকেলের এক বিশাল সাগর। আর পৃথিবীর একদম কেন্দ্রে রয়েছে ‘ইনার কোর’, যার তাপমাত্রা প্রায় ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার সমান।
প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলেও কোলা সুপারডিপ বোরহোল ভূতত্ত্ববিদ্যায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই খনন থেকে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো হলো:
১. অণুজীবের সন্ধান: মাটির প্রায় ২ কিলোমিটার গভীরে ২৪ প্রজাতির প্রাচীন অণুজীবের জীবাশ্ম বা মাইক্রোফসিলের রাসায়নিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, যা প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে নতুন ধারণা দেয়।
২. প্রাচীন শিলা: বিজ্ঞানীরা মাটির গভীর থেকে ২৫ কোটি বছরেরও বেশি পুরনো শিলা বা পাথরের নমুনা সংগ্রহ করতে সক্ষম হন, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
৩. ভুল প্রমাণিত হলো ধারণা: আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, মাটির গভীরে গ্রানাইট স্তরের নিচেই ব্যাসাল্ট শিলা পাওয়া যাবে। কিন্তু এই খনন সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে, যা ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় বড় ধরনের সংশোধন নিয়ে আসে।
কোলা সুপারডিপ বোরহোল আজও এক বিস্ময়ের নাম। এটি মনে করিয়ে দেয়, পায়ের নিচের পৃথিবীটা যতটা শীতল মনে হয়, তার গভীরে ঠিক ততটাই দাউদাউ করে জ্বলছে এক অগ্নিকুণ্ড।



