চারটি সক্রিয় ফাটলরেখায় বাংলাদেশ: বড় ভূমিকম্পের অনিবার্য ঝুঁকি
নিজস্ব প্রতিবেদক: ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বড় মাত্রার ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশটির ভেতরে ও সীমানার কাছাকাছি একাধিক সক্রিয় ভূ-ফাটল বা ‘ফল্ট লাইন’ এই ঝুঁকিকে অনিবার্য করে তুলেছে। ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব ফাটলে দীর্ঘকাল ধরে শক্তি জমা হচ্ছে, যা যেকোনো সময় বড় ধরনের কম্পন সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের জন্য প্রধানত চারটি ফাটলরেখা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এগুলো হলো—হিমালয় সাবডাকশন জোন, চট্টগ্রাম-আরাকান ফাটল, ডাউকি ফাটল এবং মধুপুর ফাটল।
প্রায় সাড়ে ৫ কোটি বছর আগে ভারত ও বার্মা প্লেটের সঙ্গে ইউরেশীয় প্লেটের সংঘর্ষে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়। এই সংঘর্ষের ফলে প্রায় ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘হিমালয় সাবডাকশন জোন’ তৈরি হয়েছে। ভারতীয় প্লেটটি এখনও ইউরেশীয় প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে সেখানে বিপুল শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে (স্লেমোনের সূত্রানুযায়ী), এই ফাটল থেকে সর্বোচ্চ ৯.২ থেকে ৯.৩ মাত্রার প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত সবচেয়ে দীর্ঘ ফাটলটি হলো চট্টগ্রাম-আরাকান ফাটল। প্রায় ৯১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফাটলটি চট্টগ্রাম উপকূল থেকে মিয়ানমার উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত। এখান থেকে সর্বোচ্চ ৮.৮ থেকে ৮.৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। ইতিহাসের নথিপত্র অনুযায়ী, ১৭৬২ সালে এই ফাটল থেকে সৃষ্ট ৮.৫ থেকে ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে দেশের ভৌগোলিক মানচিত্র বদলে গিয়েছিল। ওই কম্পনের ফলেই ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নদীর জন্ম হয়। ফাটলটি চট্টগ্রাম বিভাগে অবস্থিত হওয়ায় যেকোনো বড় কম্পনে এই অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত ৩৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ফাটলটির নাম ‘ডাউকি ফল্ট’। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, এটি সর্বোচ্চ ৮.৩ থেকে ৮.৪ মাত্রার ভূমিকম্প তৈরির ক্ষমতা রাখে। ১৮৯৭ সালে ডাউকি ফাটল এবং ভারতের ওলধাম ফাটল সক্রিয় হয়ে ৮.২ থেকে ৮.৩ মাত্রার যে ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছিল, তা ইতিহাসে ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। ওই ভূমিকম্পে ছোট সোনা মসজিদ, বাঘা মসজিদ, কুসুম্বা মসজিদ ও কান্তজিউ মন্দিরসহ দেশের বহু প্রত্নতাত্ত্বিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
রাজধানী ঢাকার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকির কারণ ‘মধুপুর ফাটল’। ১১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই ফাটলটি দেশের অন্যতম ছোট ফাটল হলেও এর অবস্থানগত গুরুত্ব অনেক বেশি। ফাটলটির দক্ষিণ অংশ সরাসরি ঢাকা শহরের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ভূতাত্ত্বিকরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, ছোট হলেও এই ফাটলটি ৭.৮ থেকে ৭.৯ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে সক্ষম, যা ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও ঐতিহাসিক রেকর্ড বলছে, বাংলাদেশ জালের মতো ছড়িয়ে থাকা এসব সক্রিয় ফাটলরেখার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যেহেতু অতীতে এসব ফাটল থেকে ভয়াবহ কম্পন সৃষ্টি হয়েছে এবং বর্তমানেও সেখানে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, তাই ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্পের বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত। তবে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠিক কবে বা কোন ফাটল থেকে আঘাত হানবে, তা আগে থেকে নিশ্চিত করে বলা বিজ্ঞানের পক্ষে অসম্ভব। তবুও এই ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি ও সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।



