দেশপরিবেশপ্রযুক্তিপ্রাকৃতিক দুর্যোগবাংলাদেশবিশ্লেষণমিডিয়াসংগৃহীত সংবাদ

ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলা: চাই প্রযুক্তিগত প্রতিরোধ ও জাতীয় মহাপরিকল্পনা

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: প্রকৃতির এক রূঢ় ও পূর্বাভাসহীন বাস্তবতা হলো ভূমিকম্প, যা মুহূর্তের মধ্যে মানবসভ্যতাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ভূমিকম্পের আতঙ্কের মধ্যে ছয়জন মানুষের প্রাণহানি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, এই দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা কতটা অরক্ষিত। ভূমিকম্প মোকাবিলা মানে কেবল দুর্যোগ পরবর্তী ত্রাণ বিতরণ নয়; বরং এটি জাতীয় স্থিতিস্থাপকতা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং সামাজিক সচেতনতার এক সমন্বিত মহাপরিকল্পনা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাসে চারটি প্রধান স্তম্ভের ওপর জোর দেওয়া জরুরি: কাঠামোগত প্রতিরোধ, প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক প্রস্তুতি, তাৎক্ষণিক সাড়াদান এবং সামাজিক পুনর্গঠন।

ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর প্রথম ধাপই হলো সঠিক নির্মাণশৈলী। জাতীয় বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মেনে চলা এবং আন্তর্জাতিক মানের ভূমিকম্প-সহনশীল নকশা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। আধুনিক স্থাপত্য প্রকৌশলে ‘বেস আইসোলেশন’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে ভবনের নিচে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রাবার বা স্প্রিং বসিয়ে মাটির কম্পন থেকে ভবনকে আলাদা রাখা হয়। এছাড়া বহুতল ভবনে বাতাসের চাপ ও কম্পন শোষণে ‘স্ট্রাকচারাল ড্যাম্পার’ প্রযুক্তি ব্যবহার জরুরি।

নতুন ভবনের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো ভবনগুলোকে ‘রেট্রোফিটিং’-এর মাধ্যমে শক্তিশালী করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ বা ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। হাসপাতাল, স্কুল, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গ্যাসলাইনের মতো জরুরি অবকাঠামোগুলোতে স্বয়ংক্রিয় ‘শাট-অফ’ প্রযুক্তি যুক্ত করা প্রয়োজন, যাতে কম্পন শুরু হওয়ামাত্র অগ্নিকাণ্ড বা বড় দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।

বড় ধরনের দুর্যোগ দেশের অর্থনীতিকে ধসিয়ে দিতে পারে। তাই ঝুঁকি স্থানান্তরের জন্য বিমা ব্যবস্থার প্রচলন অত্যন্ত জরুরি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের সম্পদের সুরক্ষায় ভূমিকম্প বিমাকে সহজলভ্য করতে হবে। সরকার এ ক্ষেত্রে কর ছাড়ের সুবিধা দিতে পারে। পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে ‘দুর্যোগ ঝুঁকি তহবিল’ গঠন এবং আন্তর্জাতিক ‘ক্যাটাস্ট্রফি বন্ড’-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন, যেন দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে দ্রুত অর্থায়ন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা যায়।

ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে উদ্ধারকাজ চালানো কঠিন। তাই স্থানীয় পর্যায়ে ‘ফার্স্ট রেসপন্ডার’ বা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা আবশ্যক। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সমন্বিত মহড়া ও সুস্পষ্ট দায়িত্ব বণ্টন থাকতে হবে। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বা ‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ নিয়ে গবেষণা ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কম্পন শুরুর কয়েক সেকেন্ড আগের সতর্কবার্তা গ্যাস সংযোগ বন্ধ বা ট্রেন থামানোর মতো জরুরি পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করতে পারে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত ‘ড্রপ, কাভার এবং হোল্ড অন’ মহড়া বাধ্যতামূলক করা উচিত।

প্রতিটি পরিবারের উচিত অন্তত ৭২ ঘণ্টার জন্য শুকনো খাবার, পানি, জরুরি ওষুধ, রেডিও ও টর্চলাইটসহ একটি ‘ইমার্জেন্সি কিট’ প্রস্তুত রাখা। পরিবারের সদস্যদের গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করার নিয়ম এবং নিরাপদ আশ্রয়স্থল সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। কম্পন চলাকালীন আতঙ্কিত না হয়ে শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নেওয়া এবং কম্পন থামলে দ্রুত খোলা জায়গায় সরে যাওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।

ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এ সময় মোবাইলে ভয়েস কলের বদলে টেক্সট মেসেজ ব্যবহার করা শ্রেয়। আহতদের উদ্ধারে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা, হাড় ভাঙলে নাড়াচাড়া না করে স্প্লিন্ট ব্যবহার করা এবং রোগীকে উষ্ণ রাখার মতো প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান থাকা জরুরি। গুজব রোধে সরকারি তথ্যের ওপর নির্ভর করা এবং মানসিক মনোবল অটুট রাখা এ সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দুর্যোগ পরবর্তী ধাপে কেবল দালানকোঠা পুনর্নির্মাণই যথেষ্ট নয়, বরং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবিকা ও মানসিক স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার জরুরি। ধ্বংসস্তূপের বর্জ্য অপসারণে পরিবেশগত মানদণ্ড মানতে হবে। সামাজিকভাবে ‘নেবারহুড ওয়াচ প্রোগ্রাম’ বা পাড়াভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা যেতে পারে, যারা পেশাদার বাহিনী আসার আগেই উদ্ধারকাজ শুরু করতে পারবে। সর্বোপরি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ও নীতিমালার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা মানুষের সাধ্যের বাইরে, কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে জানমালের ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। সচেতনতা, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থাই পারে এই বিপর্যয় থেকে আমাদের রক্ষা করতে।

লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button