অপরাধএক্সক্লুসিভদুর্নীতিদেশপ্রতারনাপ্রশাসনবাংলাদেশমিডিয়াসম্পাদকীয়

ফজলে করিম চৌধুরী ও ফারাজের বিরুদ্ধে হত্যাসহ ডজন মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম জেলা রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ও তার পুত্র ফারাজ করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ,হয়নি, আয়না ঘর, মুক্তিপণ আদায়, হত্যাচেষ্টা, হত্যা, অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো, অস্ত্রের মুখে জমি লিখিয়ে নেয়া, দখল, এবং অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় মামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে বাপ বেটার বিরুদ্ধে ,চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় বর্তমানে ডজনেরও বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে, ফজলে করিম চৌধুরী জেল হাজতে থাকলেও তার ছেলে রয়েছেন পলাত।

বর্তমানে ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নুরু হত্যা মামলায় ফজলে করিম চৌধুরীকে ৩ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।

২০১৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে নগরের চন্দনপুরার বাসা থেকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায় নুরুল আলম নুরুকে। রাউজান থানার এসআই শেখ মুহাম্মদ জাবেদ এই অপহরণের ঘটনায় নেতৃত্ব দেন।
জমি দখল*: ফজলে করিম চৌধুরী তার ক্ষমতার দাপটে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় জমি দখল করেছেন।

অস্ত্রের ব্যবসা: তার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ব্যবসা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ রয়েছে একাধিক।

পবিত্র কোরআন শরীফ পোড়ানো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, এবাদতখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর, নগদ অর্থ, প্রয়োজনীয় দলিলপত্র ও সম্পদ লুট, অগ্নিসংযোগ, হত্যার চেষ্টাসহ নানা অভিযোগে সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ও তার পুত্র সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচিত মুখ ফারাজ করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাউজান থানায় আরো একটি মামলাও রয়েছে।

২৬ আগস্ট মামলাটি দায়ের করেন রাউজান উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের এয়াসিন নগরের বাসিন্দা এবং ত্বরিকত ভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন মুনিরিয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশের ২০৪ নম্বর ফকির টিলা শাখার সহ সভাপতি মো. জোহেল উদ্দিন।
মামলায় এই বাপ-বেটা ছাড়াও রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম এহেছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুল, পৌরসভা মেয়র জমির উদ্দিন পারভেজ, পৌর প্যানেল মেয়র বশির উদ্দিন খান, পৌর কাউন্সিলর কাজী ইকবালসহ ৪৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ২০/৩০ জনকে আসামী করা হয়।

মামলার এজহার সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৯ সালের ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় ৬ টার পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এজাহারনামীয় আসামী সাংসদ এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, পৌর মেয়র জমির উদ্দিন পারভেজ, উপজেলা চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল ও ফারাজ করিম চৌধুরীর নির্দেশে বাকী আসামীসহ ২০/৩০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল ধারালো কিরিচ, ছুরি, রামদা, হকিস্টিক, ধারালো দা, লোহার রড, হাতুড়ি, রাম-দা, মাস্তুল ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বুলডোজারসহ ঘটনাস্থলে অর্থাৎ মুনিরীয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশের ২০৪ নং ফকিরটিলা শাখা (এবাদত খানা)-র সামনে এসে শক্তির মহড়া প্রদর্শন ও এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে আসামীগণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গালিগালাজ করে শাখা কার্যালয়ে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে অনধিকার প্রবেশ করে শোর চিৎকার করে ফাঁকা গুলি ছেড়ে আতংক সৃষ্টি করে। লোহার রড দিয়ে শাখার ডিজিটাল সাইনবোর্ড দরজা, জানালা ও গ্লাস ভেঙ্গে ফেলে। লোহার রড, হকিস্টিক, হাতুড়ি, রাম-দা, মাস্তুল দ্বারা এবাদতখানার ১ (এক) তলা ভাঙ্গা শুরু করে। পরে বুলডোজার দিয়ে শাখা কার্যালয় (এবাদত খানা)’র একতলা ভবন এবং উক্ত এবাদত খানাস্থ ৪টি ভাড়া দোকান ফার্মেসী, মুরগীর দোকান, স্টেশনারী দোকান, চায়ের দোকান ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। এসময় তারা শাখার বড় স্ট্যান্ড ফ্যান, কাঠের আলমারি অন্যান্য দামী সামগ্রীসহ লোহার লড, ইট, দোকানের মালামালসহ প্রায় ১০ লাখ টাকার লুট করে নেয়। যাওয়ার প্রাক্কালে এবাদত খানা ও কার্যালয়ের ভেতরে গানপাউডার ছিটিয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে শাখার কার্যালয়ে থাকা বিভিন্ন আসবাবপত্র, কাগজপত্র বিশেষ করে পবিত্র কোরআন শরীফ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এবাদতখানা, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসহ পুরো কার্যালয়টি একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০লাখ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়।

মামলার বাদী মোহাম্মদ জোহেল উদ্দিন জানান, বর্তমানে কার্যালয়টি জরাজীর্ণ ভাবে পড়ে আছে। উক্ত ঘটনার বিষয়ে তৎকালীন সময়ে স্থানীয় প্রশাসন হতে কোন প্রকার সহযোগিতা না পাওয়ায় এবং ১নং আসামী অত্র এলাকার তৎকালীন ক্ষমতাসীন সংসদ সদস্য, ২নং আসামী অত্র রাউজানের তৎকালীন পৌরসভার মেয়র ও ৩নং আসামী উপজেলা চেয়ারম্যান তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারে আমি বাদীকে সহ মুনিরীয়া যুব তবলীগ কমিটির অন্যান্য সদস্যদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়া হয়রানি করে। দীর্ঘদিন যাবৎ নিজ এলাকায় অবস্থান করতে না পারায় এবং রাজনৈতিক হয়রানির স্বীকার হওয়ায় এজাহার দায়ের করতে বিলম্ব হয়।

উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আওয়ামী সরকার পতনের পর গত ২৩ আগস্ট রাউজান থানায় রাউজানে একছাত্র অধিপত্যে বিস্তারকারী আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীসহ ৪৩জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। মুনিরীয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশের ১০৩ নম্বর দলইনগর-নোয়াজিষপুর শাখা (এবাদত খানা) ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, এবাদত খানায় অবস্থানরত সদস্যদের হত্যার চেষ্টাসহ নানা অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন উক্ত শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন। এছাড়াও গত ১৯ আগস্ট দুপুরে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাবেক সংসদ ফজলে করিম চৌধুরীসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেন পশ্চিম গুজরা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মো. সিরাজদৌল্লাহ। এবং ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই সংসদ সদস্য সহ ২৩ জনকে আসামী করে দ্রুত বিচার আইনে আরেকটি মামলা হয় (মামলা নং-১৬/২০২৪)। মামলাটি দায়ের করেন বিনাজুরী ইউনিয়নের বাসিন্দা ইসতিয়াক হোসেন প্রকাশ বজল। সাবেক এই প্রভাবশালী সংসদের বিরুদ্ধে আরো বেশ কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে ভুক্তভোগী সুত্রে জানা যায়।

চট্টগ্রাম ৬ আসন এই ফজলে করিম চৌধুরীর কথাই ছিল শেষ কথা: বাংলাদেশ থেকে আলাদা রাষ্ট্র মনে করতেন রাউজানকে ফজলে করিম চৌধুরী ।নিজেকে এলাকায় প্রচার করেছেন তিনি একমাত্র অত্র এলাকার রাজা তার কথাই শেষ কথা।

চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র-গুলি উদ্ধার করা হয়েছি। আর বাসভবনে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে রাউজান উপজেলার গহিরায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করেন।

তখনকার চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান গণমাধ্যমকে দেয়া তথ্য, ফজলে করিম চৌধুরীর বাড়ির আলমারিতে থাকা একটি পয়েন্ট ২২ বোরের রাইফেল, একটি এলজি, একটি রিভলবার, একটি শটগান ও সাত রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছিল। উদ্ধার হওয়া এসব অস্ত্রের মধ্যে শুধু রাইফেলের লাইসেন্স ছিল। বাকি অস্ত্র অবৈধ। সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বৈধ অস্ত্র জমা না দেওয়ায় সেটিও অবৈধ হয়ে যায়। অস্ত্র–গুলি উদ্ধারের ঘটনায় রাউজান থানায় মামলাও হয়।

ঐদিন এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর নগরের খুলশী এলাকার একটি ফ্ল্যাটেও অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু সেখানে কিছু পাওয়া যায়নি।১২ সেপ্টেম্বর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তের আবদুল্লাহপুর এলাকা থেকে এ বি এম ফজলে করিমসহ তিনজনকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ফজলে করিম আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে বিজিবি জানিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে মামলা হয়েছে ১০টি, এরপর আরো একাধিক মামলা হয়। এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য নিরাপত্তার কারণে তাঁকে ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে আনা হয় হেলিকপ্টারে করে।

কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ফজলে করিমকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হয়। রাউজানে মুনিরীয়া যুব তবলিগ কমিটির ইবাদতখানা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের দুই মামলা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের ঘটনায় পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও থানার দুই মামলা এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসম্পাদক নুরুল আলম হত্যার ঘটনায় চকবাজার থানার মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছেন আদালত।

পরে ফজলে করিমকে প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়ার সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন ডিম ছুড়ে মারেন। এ সময় তাঁর ফাঁসির দাবিতে তাঁরা স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় রাউজান থানার এক মামলায় ফজলে করিমকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এই ফজলে করিমের ফাঁসির দাবিতে রাউজান চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন এলাকার মানববন্ধন বিক্ষোভও হয়েছে একাধিকবার। এই বাপ বেটার অত্যাচারে চট্টগ্রাম ছাড়া হয়েছে বহু পরিবার, গুম খুন হয়ে এখনো অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে বলে অনেক অভিযোগ আছে বাপ বেটার বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগ সরকারকে পুঁজি করে রাউজানে এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী নিজেকে বানিয়েছিলেন মস্ত বড় রাজা ও বিচারপতি:

ফজলে করিম প্রকাশ জুনু করিমের নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতেন রাউজানের অপরাধের সবকিছু। প্রশাসনের আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। তার কথা ছাড়া এখানে গাছের পাতাও যেন নড়ত না অন্ধ হয়ে যেত সৃষ্টিকর্তার বাতাস সহ শুধু অসহায়দের চোখের পানিতে। এমন কথা স্বয়ং তিনিই বলতেন। ভিন্নমতের হাজারো মানুষ হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শিকার হয়েছেন গুম-খুনের। দখল-বেদখল ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী এই ফজলে করিম জনুর। বছরের পর বছর এলাকাছাড়া ছিলেন বিএনপি, জামায়াত, মুনিরিয়া যুব তবলিগসহ অঙ্গসংগঠন সহ অনেকেই। এমনকি ভিন্নমত পোষণ করে আওয়ামী লীগের লোকজনও এলাকাছাড়া হয়েছেন। কোনো অপরাধেরই বিচার হতো না।

এতকিছুর পরও কেউ তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করতে পারতেন না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ধর্মীয় সংগঠন মুনিরিয়া যুব তবলিগের নেতাকর্মী-সমর্থকরা সবচেয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ সংস্থার অফিস, কর্মীদের ঘরবাড়িতে দিনের পর দিন হামলা-ভাঙচুর হলেও অবাক বিস্ময়ে দেখা ছাড়া কোনো কিছুই যেন করার ছিল না তাদের। তবে ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ফজলে করিম এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলে রাউজানের সাধারণ মানুষ রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভ করেন। তারা এখন ফজলে করিমের দৃ-ষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রহর গুনছেন। বাপ বেটার ফাঁসি চায় রাউজান বাসি।

রাউজানে ফজলে করিম ও তার অনুসারীদের হাতে নির্যাতিত ও অসহায় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে ১৬ বছরের এই চিত্র পাওয়া গেছে।

জানা যায়, নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের বিরোধী কণ্ঠ হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) কর্মী ছিলেন ফজলে করিম। কাজ করেছেন দলটির ওই সময়কার প্রধান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কর্মী হিসাবে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে চাঁদাবাজি-ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে এনডিপির এসকান্দরসহ ৪০-৪৫ জন ক্যাডার নিয়ে দল থেকে হঠাৎ পদত্যাগ করেন ফজলে করিম। এর পরপরই তার আত্মীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে হাত করে রাতারাতি ঢুকে পড়েন রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে চাচাতো ভাই বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ৭ হাজার ৩২৯ ভোটে হারিয়ে চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সংসদ-সদস্য হন তিনি। চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিনটিতে কোনো ভোটই হয়নি। তার এই এককাধিপত্য তাকে ভয়ংকর করে তোলে। সে হয়ে যায় ভয়ংকর থেকে আরও ভয়ংকর।নিজেকে নিয়ে মন্তব্যের মধ্যেই তার ভয়ংকর হয়ে ওঠার চিত্র স্পষ্ট। তিনি বারবার বলতেন, বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, কিন্তু ফজলে করিম ধরলে ছাড়ে না। এখনই বাঘ অঘোষিত রাজা বন্দী কারাগারে।

কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলমের স্ত্রী সুমি আক্তার বলেন, আমার সামনে থেকে স্বামীকে শহরের বাসা থেকে তুলে নিয়েছিল ফজলে করিমের ক্যাডাররা। শহর থেকে রাউজানে নিয়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে। স্বামী খুন হয়ে গেল অথচ এর বিচার চেয়ে থানায় মামলাও করতে পারিনি। ঘটনার সাত বছর পর চকবাজার থানায় ফজলে করিম চৌধুরীসহ ১৭ জনকে আসামি করে মামলা করেছি।
নুরুল হত্যা মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ নগরের চকবাজার থানাধীন চন্দনপুরার পশ্চিম গলির মিন্নিমহল বাসায় রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে ফজলে করিমের সরাসরি নির্দেশে রাউজান থানার তৎকালীন ওসি কেফায়েত উল্লাহর হুকুমে এসআই জাবেদ অফ-হোয়াইট কালারের টি-শার্ট পরিহিত অবস্থায় অস্ত্র হাতে এসে দরজায় নক করেন। তখন নুরুলের ভাগিনা রাশেদুল ইসলাম বাসার প্রধান দরজা খুলে দেন। এ সময় বাসায় ঘুমন্ত নুরুল আলমকে বিছানা থেকে টেনে তুলে হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন এসআই জাবেদ। তখন পরিবারের সদস্যদের পুলিশ জানায়, পরোয়ানামূলে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে পরিবারের সদস্যরা পরোয়ানা দেখতে চাইলে পুলিশ দেখায়নি। বাসার তিনটি মোবাইল ফোনসহ নুরুলকে বাইরে অপেক্ষমাণ একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে নোয়াপাড়া কলেজ ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কাপড় দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে ও রশি দিয়ে দুই হাত বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে তার মাথায় গুলি করে হত্যার পর রাউজান বাগোয়ান ইউনিয়নের খেলারঘাট কর্ণফুলী নদীর তীরে লাশ ফেলে দেওয়া হয়। পরদিন ৩০ মার্চ লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩১ মার্চ ময়নাতদন্ত শেষে লাশ দাফন করা হয়। ঘটনার সময় দুটি মাইক্রোবাস ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে একটি গাড়ির চালক হেলাল বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

রাউজানের ১৪ নম্বর বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু জাফর অপহরণ ও গুমের নেপথ্যেও ছিলেন ফজলে করিম। ২৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে আবু জাফরের ছেলে জিসানুর রহমান অভিযোগ করেন, র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্ট উইংয়ের প্রধান থাকাকালে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান তার অধীন র‌্যাব-৭-এর সিও লে. কর্নেল হাসিনুরকে আদেশ করেন তার বাবাকে তুলে নিয়ে হত্যা করার জন্য। সেই আদেশ অমান্য করায় হাসিনুরকে র‌্যাব থেকে বদলি করে দেওয়া হয়। পরে জিয়াউল আহসান অন্য টিম দিয়ে তার বাবাকে তুলে নিয়ে গুম করেন। এখনো তার বাবার কোনো সন্ধান মেলেনি।

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহসভাপতি সাবের সুলতান কাজল জানান, তার বিরুদ্ধে ৫০টির অধিক মামলা দিয়েছিলেন ফজলে করিম। চট্টগ্রাম নগর থেকে শুরু করে জেলার এমন কোনো থানা নেই, যেখানে তার বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য বা জামিন অযোগ্য মিথ্যা ধারার মামলা দেওয়া হয়নি। রাউজান যুবদলের অধিকাংশ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলার কারণে বিগত ১৬ বছর তিনি এলাকায় যেতে পারেননি। তার অত্যাচারে হাজার হাজার নেতাকর্মী ঘরছাড়া ছিলেন বছরের পর বছর। তিনি বলেন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুর ছাড়াও পৌরসভা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন হান্নান, উপজলা যুবদল নেতা আবুল হাশেমকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রবাসফেরত যুবদল নেতা মুসাকেও দিনদুপুরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

রাউজান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফিরোজ আহমেদের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফাহিম মোহাম্মদ রিয়াদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই তিনি নিজ এলাকায় যেতে পারেননি। বাবা যুবদল করেন, তাই তাদের এলাকায় যাওয়ার অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল বলে তিনি বড় হয়ে জানতে পেরেছেন। পরিবার নিয়ে তারা একপ্রকার আত্মগোপনেই থাকতেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আমার দাদি মারা গেছেন ২০২০ সালে, দাদা মারা গেছেন ২০২১ সালে। কিন্তু কোনো জানাজায়ই আমার বাবাসহ আমরা কেউ যেতে পারিনি। মা-বাবার কবরে আমার বাবা মাটি পর্যন্ত দিতে পারেননি। এমনকি যার হাত ধরে এবিএম ফজলে করিম রাজনীতি শুরু করেছিলেন, সেই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও নিজ এলাকায় কবর দিতে বাধা প্রদান করেন ফজলে করিমের লালিত সন্ত্রাসীরা।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের শেষ ১০ বছর স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। মাদ্রাসা-মসজিদ, স্কুল কমিটির নির্বাচন পর্যন্ত হয়নি। বিনা ভোটে তার পছন্দের লোকজনকেই তিনি প্রার্থী করে নির্বাচিত ঘোষণা করতেন। কেউ নির্বাচন করতে চাইলে তাকে ভোগ করতে হতো নানা শাস্তি। এমনকি একবার রাউজানের পৌর মেয়র হিসাবে নির্বাচিত হওয়া নিজ দলের কর্মী দেবাশীষ পালিত চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসতে পারেননি। যেতে পারেননি এলাকায়। কারণ, তার অমতে নির্বাচিত করেছিলেন দেবাশীষ।

রাউজানের ঐতিহ্যবাহী রাউজান ক্লাবে তালা দিয়েছিলেন ফজলে করিম। আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মকাণ্ডসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত এই ক্লাব। ১৬ বছরের শাসনামলে প্রথমদিকে আন্ডারগ্রাউনে কার্যক্রম চালালেও পরবর্তী সাত বছর তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয় এই ক্লাব। রাউজান ক্লাবের সভাপতি নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. ওমর ফারুক অভিযোগ করেন, রাউজান ক্লাবসহ ৮/১০টি সামাজিক সংগঠনের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফজলে করিমের ক্যাডার হিসাবে পরিচিত এনাম, জান্নাতুল ফেরদৌস ববি, ইমরান হোসেন ইমুসহ সন্ত্রাসীরা জোরপূর্বক তাদের ক্লাবে তালা মেরে দেয়। রাউজান ক্লাব ট্রাস্টের নামে থাকা ৩০ কাঠা জমি ফজলে করিম দখল করে পাওয়ার প্ল্যান্টকে দিয়ে দেয়। ভিন্নমতের অনেক ডাক্তারকে চেম্বার পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। দক্ষিণ রাউজানে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জাহাঙ্গীর আলমের চেম্বার বন্ধ করে দেন ফজলে করিমের ক্যাডাররা। ডা. আবুল কাশেমকে নোয়াপাড়া পথের হাটে চেম্বার করতে দেওয়া হয়নি। তারা কার্যত এলাকা থেকে বিতাড়িত ছিলেন।

রাউজানের কাগতিয়া, গহিরা, সুলতানপুর, মোহাম্মদপুর, পৌরসভাসহ বিভিন্ন এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাউজান উপজেলার বাসিন্দাদের বড় একটি অংশ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগঠন মুনিরিয়া যুব তবলিগ কমিটি বাংলাদেশের অনুসারী। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এ কমিটির অফিস রয়েছে। অজ্ঞাত কারণে এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এই সংগঠনের ওপর চড়াও হন। তার নির্দেশে কমিটির বেশকিছু অফিস ভাঙচুর করে ফজলে করিমের ক্যাডাররা। ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মুনিরিয়া যুব তবলিগ কমিটি বাংলাদেশের প্রায় ৮০০ জন নেতাকর্মী ও ভক্তের বাড়িঘর ভাঙচুর, তাদের থেকে চাঁদা আদায় ও এলাকাছাড়া করা হয়েছে। ৭২৪ জন নেতাকর্মী ও ভক্তের নামে মামলা করেছে। মুনিরিয়া তবলিগ কমিটির এক সদস্য বলেন, আমাদের সংগঠনটি একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। কিন্তু ফজলে করিম আমাদের ধ্বংস করার একটি পাঁয়তারা করেন। রাউজানের প্রত্যেক ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, গ্রাম পর্যায়ে থাকা আমাদের ৪০টি খানকা শরিফ (১, ২ ও ৩ তলাবিশিষ্ট) ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বুলডোজার দিয়েও ভেঙেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সিন্ডিকেট ও সিনেট সদস্য এবং মুনিরিয়া যুব তবলিগ কমিটি বাংলাদেশের মহাসচিব (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুরের বাড়ি দুই দফা ভাঙচুর করা হয়। সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান ফজলে করিম চৌধুরী। ১৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সিমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় দুই সহযোগীসহ তাকে হাতেনাতে আটক করে বিজিবি। ৩২ মামলার আসামি হয়ে বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে রয়েছেন ফজলে করিম। ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ ও রাউজান থানা পুলিশ তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। এর মধ্যে রয়েছে রিভলভার, পিস্তল, রাইফেল, শটগান, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার, বিপুল পরিমাণ গুলি, একনলা বন্দুক ও বন্দুকের কার্তুজ, বিস্ফোরক দ্রব্য। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করে রাউজান থানা পুলিশ।

রাউজানের বিচারপতি খ্যাত ফারাজ করিম অপরাধে জড়িয়ে ছিলেন তার একমাত্র পিতা এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর ইশারায় করেছেন অপহরণ হত্যা, রাহাজানি, জমি দখল, বিচারের নামে নিরীহাদের উপর জুলুম অমানবিক নির্যাতন সহ বহু অভিযোগ এই ফারাজ করিমের বিরুদ্ধে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button