অপরাধঅব্যাবস্থাপনাআইন, ও বিচারসিলেট

খাদিমনগর চা বাগানে সাইনবোর্ড উচ্ছেদ কার ছত্রছায়ায় চলছে এই দখলবাণিজ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট ব্যুরো: সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর চা বাগানজুড়ে সরকারি খাসজমি দখল, পাহাড়–টিলা কাটা, সীমানা ভাঙচুর এবং অনুমোদনবিহীন জমি বেচাকেনার এক জটিল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এলাকাটি সিসিকের ৩৪ ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড, দিনাশাহ পরান থানা, দেবপুর মৌজা (জে.এল. 9681) এবং খাদিমনগর মৌজা (জে.এল. ৭০ ও ৭১)-এর অন্তর্ভুক্ত—যেখানে সরকারের লিজপ্রাপ্ত চা বাগানের জমি বছর বছর উজাড় হয়ে যাচ্ছে।এখানে গিয়ে দেখা যায়—বাগানের সীমানা চিহ্নিত করতে স্থাপন করা সাইনবোর্ডগুলো ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, “সাইনবোর্ড লাগানো হয়, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা ফেলে দেওয়া হয়।”

এ যেন অদৃশ্য কারো ইঙ্গিতে পরিচালিত সুসংগঠিত অভিযানেরই প্রদর্শনী।জমি দখল—বিক্রি—আবাসিক বস্তি: সবই চলছে স্ট্যাম্প বাণিজ্যের মাধ্যমেস্থানীয় সূত্রের দাবি, দিনের পর দিন কেটে ফেলা হচ্ছে পাহাড়–টিলা, উজাড় হচ্ছে জঙ্গল ও ছড়া–খাল, আর সেই ভূমি রাতারাতি রূপ নিচ্ছে “আবাসিক বস্তি এলাকা”-তে।

অভিযোগ উঠেছে—এই বস্তিগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে চলছে জমি দখল ও বেচাকেনা; স্ট্যাম্পে লিখে জমি হাতবদলের অসংখ্য প্রমাণও নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে এলাকায়।একাধিক ব্যক্তি জানান, মামলার আড়ালে সৃষ্ট “ল্যান্ড ডিসপিউট” সুযোগে কিছু প্রভাবশালী মহল আইনি প্রক্রিয়াকে ঢাল বানিয়ে দখল ধরে রাখছে বছরের পর বছর।

বাগান কর্তৃপক্ষের অভিযোগ: ‘দখলদাররা দলবদ্ধ, আমরা অসহায়’ লিজগ্রহীতা নীনা আফজাল রশিদ চৌধুরীর পক্ষে বাগান ম্যানেজার আতিকুর রহমান জানান—“প্রতিবার সীমানা চিহ্নিত করতে গেলে সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলা হয়। চৌকিদারদের ওপর হামলার হুমকি দেওয়া হয়। দখলদাররা দলবদ্ধ ও সংগঠিত—সরকারি সম্পদ রক্ষা করতে আমাদের পক্ষে একা কিছুই করা সম্ভব না।”বাগানের শ্রমিকদের একটি অংশের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে—তারা বাগানের কাজে নিয়মিত না গিয়ে বাইরের দখল–বেচাকেনায় জড়িয়ে পড়ছে।

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে শ্রমিকদের অবস্থান জানা যায়নি। প্রভাবশালী মহল ও রাজনৈতিক ছায়া: দখলের পেছনে কারা?স্থানীয়দের দাবি—বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাকর্মী, এলাকা ছাড়া বহিরাগত দখলদার ও প্রভাবশালী চক্র পরিস্থিতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে।

যে কোনো মুহূর্তে দখল করতে বড়সড় দল গঠন করে বাগানের ভেতরে ঢুকে পড়ার ঘটনাও নাকি নতুন নয়।“মামলা চলছে”—এটিই যেন তাদের প্রধান অস্ত্র।মামলা চলার সময় প্রশাসন অনেক বিষয়ে হাত দিতে পারে না—এই ফাঁক গলেই জমির দখল পোক্ত হয়, অভিযোগ স্থানীয়দের।

অভিযান–উচ্ছেদ–আবার দখল: প্রশাসনের সামনে দুভাগ বাস্তবতাসিলেট জেলা প্রশাসক মো. সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে একাধিক উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে; ধ্বংস করা হয়েছে অনেক অবৈধ স্থাপনা। ইউএনও ও এসিল্যান্ডও অভিযান পরিচালনা করেছেন।

কিন্তু বাস্তবতা হলো— উচ্ছেদের পর কিছুদিন নীরবতা থাকে, তারপর আবার শুরু হয় নতুন দখল–নতুন নির্মাণ।স্থানীয়ভাবে একে বলা হয়—“উচ্ছেদ–দখল–পুনর্দখল চক্র”বাগান কর্তৃপক্ষ, সাধারণ মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর দাবি—সরকারি খাসজমি রক্ষায় একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রভাবশালী দখলদার চক্রকে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

জাতীয় ভেজাল প্রতিরোধ ফাউন্ডেশন ও অপরাধ বিচিত্রা সূত্রে জানানো হয়েছে—“সরকারের সম্পদ রক্ষায় অভিযান ধারাবাহিক রাখতে হবে। দখলবাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এই এলাকা রক্ষা করা সম্ভব নয়।”

খাদিমনগর চা বাগানের জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা দখল–বাণিজ্য, পাহাড় কাটার মতো পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড, সাইনবোর্ড ভাঙচুর এবং প্রভাবশালী ছত্রছায়ায় জমির হাতবদল—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি দিনে দিনে জটিল হয়ে উঠছে। সরকারি সম্পদ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ না নিলেখাদিমনগরের পাহাড়–টিলা–চা বাগান একদিন পুরোপুরি বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কা আছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button