
নিজস্ব প্রতিবেদক: জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে জীবনধারণের অপরিহার্য উপাদান পানি—সবখানেই এখন ভেজাল আর ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি। সম্প্রতি আদালতের এক আদেশে নেসলের কিটক্যাট চকলেট এবং মেঘনা গ্রুপের ‘ফ্রেশ’ ব্র্যান্ডের চিনিতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সালফার ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কেবল হিমশৈলের চূড়ামাত্র; দেশের পুরো খাদ্য ব্যবস্থাই এখন চরম ঝুঁকির মুখে।
আদালতের এই রায়ের পর জনমনে প্রশ্ন উঠেছে আমদানিকৃত অন্যান্য চকলেট ও বাজারে প্রচলিত সাদা চিনির মান নিয়ে। অভিযোগ রয়েছে, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হলে অধিকাংশ ব্র্যান্ডের চিনিতেই সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো ক্ষতিকর উপাদান মিলবে। আর এসব পরীক্ষায় কেবল মান যাচাই করা হয়, কিন্তু যদি নিরাপত্তার (সেফটি) গভীর বিশ্লেষণ করা হয়, তবে বেরিয়ে আসবে আরও ভয়াবহ চিত্র।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে শাকসবজি ধোয়া হচ্ছে নর্দমার নোংরা পানি দিয়ে। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বাজারে গুড়ের চাহিদা বাড়লেও, অসাধু ব্যবসায়ীরা আখের রস ছাড়াই কেবল ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করছে গুড়। এমনকি গরুর দুধ পর্যন্ত রাসায়নিক মিশিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে রাজধানীর সুপেয় পানি নিয়ে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় ঢাকা ওয়াসার পানিতে পিএফএএস (PFAS), কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ (Pesticide Residue) এবং ফার্মাসিউটিক্যালস বর্জ্যের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে। গবেষকদের মতে, নগরবাসী প্রতিদিন গড়ে যে দুই লিটার পানি পান করছেন, তা মূলত বিষাক্ত।
চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, ওয়াসার পানির এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশের দিন সংস্থাটির কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনের পর তারা গবেষকদের কাছে অনুরোধ জানান, এই নেতিবাচক রিপোর্ট যেন জনসমক্ষে প্রকাশ না করা হয়। এরপর থেকে ওয়াসার পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করা হয়নি, এমনকি জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে কোনো গবেষণাধর্মী পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি।
খাদ্যপণ্যের দূষণ থেকে বাদ যাচ্ছে না চা পাতাও। বিভিন্ন নমুনায় রেডিয়াম, থোরিয়াম, ইউরেনিয়াম ও এন্টিমনির মতো তেজস্ক্রিয় উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় সয়াবিন তেলে মাত্রাতিরিক্ত ভারী ধাতু (Heavy Metal) বা সিসার উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক জার্নালেও প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া মাছ, মাংস, ডিম ও শাকসবজিতে ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি নিয়ে অসংখ্য গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, খাদ্যে ভেজালের এমন মহোৎসব চললেও নির্বিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ভোজ্যতেলে ভিটামিন-এ এবং লবণে আয়োডিন নিশ্চিত করার মতো গতানুগতিক কার্যক্রম ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে ব্যস্ত থাকলেও, খাদ্যের মূল বিষক্রিয়া রোধে তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
বিষাক্ত খাবার ও পানীয়ের কারণে জাতি ধিলে ধিলে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়লেও, দেখার যেন কেউ নেই।



