পর্যাপ্ত মজুত সত্ত্বেও সারের কৃত্রিম সংকট: কৃষিতে অস্থিরতা তৈরির নেপথ্যে ‘নীলনকশা’
নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি সার নিয়ে চলছে এক গভীর ষড়যন্ত্র। সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরেও মাঠপর্যায়ে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটি নিছক কোনো বাজার ব্যবস্থাপনা বা সরবরাহের ঘাটতি নয়; বরং কৃষক ও সরকারের মধ্যে দূরত্ব তৈরি এবং কৃষিখাতে অস্থিরতা সৃষ্টির এক সুপরিকল্পিত নীলনকশা।
সম্প্রতি অধ্যাপক এম এ বার্ণিক-এর এক বিশ্লেষণে সারের এই পরিকল্পিত সংকটের পেছনের কারণ, প্রভাব ও করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই সংকটের মূলে রয়েছে তিনটি প্রধান কারসাজি। প্রথমত, একশ্রেণিও অসাধু ডিলার ও গুদাম মালিক ভরা মৌসুমে সার লুকিয়ে রেখে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে কৃষকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এবং ডিএপি, ইউরিয়া ও টিএসপির মতো জরুরি সারের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা লুটছে চক্রটি।
দ্বিতীয়ত, পরিবহন ব্যবস্থায় ইচ্ছাকৃত ধীরগতি এবং কাগজে-কলমে ‘স্টক নেই’ দেখানোর প্রবণতা। স্থানীয় বাজারে সার পৌঁছাতে বিলম্ব ঘটিয়ে কৃত্রিম হাহাকার তৈরি করা হচ্ছে, যা মাঠের বাস্তব চিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
তৃতীয়ত, এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি। সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক সমাজের অসন্তোষ উসকে দিতে একটি বিশেষ মহল সার সংকটকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে। অতীতেও নির্বাচনের আগে বা কৃষি মৌসুম ঘিরে এমন তৎপরতা দেখা গেছে।
এই সিন্ডিকেটের নির্মম শিকার হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। বীজতলা তৈরি ও রোপণের মোক্ষম সময়ে সার না পাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। বাধ্য হয়ে চড়া দামে সার কিনতে গিয়ে ঋণের বোঝা বাড়ছে কৃষকের কাঁধে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এভাবে চলতে থাকলে কৃষি উৎপাদন কমে যাবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তায় এবং বাড়বে খাদ্যপণ্যের দাম।
সরকারি ভাষ্যমতে, দেশে সারের জাতীয় মজুত সন্তোষজনক এবং বরাদ্দও পর্যাপ্ত। সংকট মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও কৃষি বিভাগকে যৌথভাবে তদারকির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মজুতদারি প্রমাণিত হলে লাইসেন্স বাতিলসহ ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও মাঠপর্যায়ে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমছে না।
এই সংকটের পেছনে তিনটি মূল উদ্দেশ্য কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে— ১. অর্থনৈতিকভাবে অতি মুনাফা লাভ, ২. রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি এবং ৩. সার ব্যবসার সরবরাহ শৃঙ্খল বা সাপ্লাই চেইনের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
কৃষিখাতের এই বিপর্যয় রোধে বেশ কিছু সুপারিশ উঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে—
- স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ: প্রতিটি ইউনিয়নে সারের দৈনিক মজুত ও মূল্যের তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করা এবং ডিলারদের কার্যক্রম ডিজিটাল নজরদারির আওতায় আনা।
- কঠোর অভিযান: মজুতদার ও কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং লাইসেন্স বাতিলসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
- সরাসরি অভিযোগ গ্রহণ: হটলাইন ও অ্যাপ চালু করে কৃষকদের অভিযোগ তাৎক্ষণিক আমলে নেওয়া এবং কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
বিশ্লেষকদের মতে, সারের এই সংকট সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। এই চক্রকে এখনই চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে কৃষিখাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে, যা দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।



