নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার বিস্তীর্ণ জনপদ—বাংলা বাজার, ডেবার পাড়, জামতলা, আরফিন নগর, মুক্তিযোদ্ধা কলোনী ও সংলগ্ন প্রান্তর—বহু বছর ধরে এক ব্যক্তির অদৃশ্য অথচ অনিবার্য প্রভাববলয়ে আবদ্ধ ছিল। অভিযোগের কেন্দ্রে থাকা সেই ব্যক্তির নাম—আলমগীর হোসেন।
তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর পরিধি বিস্ময়করভাবে ব্যাপক—ভূমি দখল, দখলবাণিজ্য, দাফতরিক কাগজপত্রে কারসাজি, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, মামলা–বাণিজ্য, রাজনৈতিক ছায়াতলে ত্রাস সৃষ্টির প্রবণতা—ইত্যাদি নানা অপরাধের অভিযোগে তিনি দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় ছিলেন এক ভীতিকর প্রতীকের মতো।এক দীর্ঘ অনুসন্ধানে স্থানীয়দের দগদগে বর্ণনা, পুরোনো মামলার নথি, প্রশাসনের কয়েকজন গোপন–সুত্রের বক্তব্য এবং বহুদিনের জমাটবাঁধা ক্ষোভের মিশ্রণে উঠে এসেছে এক উদ্বেগজনক বাস্তবচিত্র।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, আলমগীরের ত্রাস ছিল এক অদৃশ্য প্রাচীর—দৃশ্যমান না হলেও ভীতিকর বাস্তবতা।বাংলা বাজারের এক চা দোকানদার বলেন—উনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু হলে মুহূর্তেই মামলা দেওয়ার কথা বলতেন। পুলিশে যাওয়ার সাহসও থাকত না। যেন অত্র এলাকায় তার কথাই ছিল শেষ কথা।ডেবার পাড়ের এক প্রবীণ পুরুষের বর্ণনা আরও মর্মন্তুদ— আমার ভাইয়ের জমি দখল করতে চাইলে প্রতিবাদ করি। তার লোকজন হামলা করে। থানায় গিয়ে দেখলাম, ‘ক্ষমতাবান লোক’ বলে সবাই এড়িয়ে গেল। ন্যায়বিচারে আমরা তখন এতিমের মতো।আরফিন নগরের এক নারী বলেন—নারী নির্যাতনের মামলায় বেশ কিছুদিন জেলে ছিলেন বটে, কিন্তু বের হয়ে আবার সেই পুরোনো রূপে ফিরে এলেন এই আলমগীর। যেন তার ওপর কোনো আইনই কার্যকর নয়।
স্থানীয়দের একাংশ অভিমত দেন—এক সময় এমন অবস্থা হয়েছিল যে, মানুষ নিজের জমিতে দাঁড়াতেও ভয় পেত। কারণ আলমগীর চাইলে সেই জমিও নিয়ে নিতে পারে—এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল।
দিনমজুর আর রাজমিস্ত্রি থেকে প্রভাবশালীতার মঞ্চে আলমগীরের উত্থানঅনুসন্ধানে জানা যায়—ময়মনসিংহ থেকে এসেছিলেন একেবারে হাতের মেহনতির কাজে। কখনো রাজমিস্ত্রি, কখনো দারোয়ান—ইট-বালুর ঘ্রাণই ছিল জীবনের সঙ্গী। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছবি তুলে, রাজনৈতিক ব্যানার–ফেস্টুনে নাম সংযুক্ত করে, এবং নেতৃত্বের সঙ্গে সখ্যতার ‘ছবি–রাজনীতির’ মাধ্যমে দ্রুতই নিজের অবস্থান বদলে ফেলেন।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর ভাষায়—ছোট কাজ করতেন, হঠাৎ দেখলাম বিপুল সম্পত্তির মালিক। একাধিক প্লট, বাড়িঘর, গাড়ি—সব যেন রাতারাতি হয়ে গেল।এক প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি সংশ্লিষ্ট থানা থেকে বহুদিন আগে বদলি হয়েছেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন—তার টাকা–পয়সার উৎস ছিল রহস্যময়। জমি নিয়ে অভিযোগ এলে রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তদন্ত মাঝপথেই থেমে যেত।অনুসন্ধান বলছে—গত দশ বছরে তার আর্থিক সামর্থ্য এমন হঠাৎ বাড়ে যে, অনেকেই সন্দেহ করেন ‘রাজনৈতিক ছায়া’ই ছিল তার প্রধান বর্ম।মামলা–বাণিজ্য: ভয়ের বাজার সৃষ্টিজামতলার এক ব্যবসায়ী কণ্ঠে ক্ষোভ—দুইবার মামলা দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা নিতে হয়েছে। থানায় গেলে বলা হতো—এটা নাকি রাজনৈতিক ব্যাপার। আমাদের কথা কেউ শুনত না।এলাকার সাধারণ মানুষের দাবি—আলমগীরের ঘনিষ্ঠদের একটি চক্র মানুষকে সামান্য বিরোধেও ভীতি দেখিয়ে জিডি বা মামলা করিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করত। এটাকে তারা স্থানীয় ভাষায় বলতেন—মামলার হাট বসানো।
আবার কি দৌরাত্ম্যের অবসান? সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তার প্রভাব কমে এসেছে বলে জানান এলাকার বেশিরভাগ মানুষ। একজন বাসিন্দা বলেন—এখন আগের মতো দাপট নেই। তবে শুনছি, নতুন দলে যোগ দিতে চাইছেন। টাকা খরচ করে পদ কিনতে নাকি চেষ্টা করছেন।ওই অঞ্চলের মানুষের আশঙ্কা—যদি আবার রাজনৈতিক আশ্রয় পান, তাহলে পুরোনো ত্রাস ফিরে আসবে।
অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে বায়েজিদ থানার এক কর্মকর্তা বলেন—তার বিরুদ্ধে পুরোনো কিছু মামলা রয়েছে, যা আদালতে বিচারাধীন। নতুন অভিযোগ পেলে লিখিত আবেদন অনুযায়ী তদন্ত হবে।জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একজন সদস্য জানান— রাজনৈতিক পরিচয়ের অপব্যবহার করে অপরাধ সংগঠনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সন্দেহভাজনদের ওপর নজরদারি চলছে।বিশেষজ্ঞদের মত: রাজনীতির আবরণে অপরাধ ঢেকে দিলে সমাজ ক্ষয় হয়চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন—রাজনীতির বাহুবন্ধনে অপরাধীরা শক্তি সঞ্চয় করলে জনগণের ন্যায়বোধ ভেঙে পড়ে। প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কঠোর হতে হবে, নইলে এই ধরনের ব্যক্তিরা পুরো এলাকাকে নিজের সাম্রাজ্যে পরিণত করে।তার মতে—ক্ষমতার অপব্যবহার যখন নিত্যকার চর্চা হয়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিই ক্ষয়িষ্ণু হয়।
‘আমরা ন্যায় চাই, ভয় নয় এলাকাবাসীরা একবাক্যে যে আহ্বান জানিয়েছেন তা হলো—তিনি যে দলেরই হোন, অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। জমি দখল, নারী নির্যাতন, মামলা–বাণিজ্য—সবকিছুর সঠিক বিচার হওয়া প্রয়োজন।তাদের মতে—চুপ থাকলে অপরাধীরা শক্তিশালী হয়, আর দুর্বল হয় সাধারণ মানুষ।
অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর প্রত্যাশা বায়েজিদ জনপদের বাসিন্দারা বহু বছর ধরে যে ভয়ের আবরণে বাস করেছেন, সেই ইতিহাস মুছে দিতে পারে কেবল সত্য, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষ বিচার। অভিযোগের ভারে নিমজ্জিত এই অধ্যায়ের শেষ কোথায়—তা নির্ভর করবে রাষ্ট্র, প্রশাসন ও জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তির ওপর।মানুষের বিশ্বাস পুনরুদ্ধার হবে তখনই,যখন ক্ষমতা নয়—ন্যায় হবে সর্বোচ্চ সত্য।



