
মুহাম্মদ জুবাইর: চট্টগ্রাম জেলার আইন-শৃঙ্খলার অভিভাবক, পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলাম সানতু, বিপিএম-বার—বদলিজনিত কারণে দায়িত্ব ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। ৩২৮ দিনের কর্মক্লান্ত পথচলা—যা ছিল সততা, শৃঙ্খলা, মানবিকতা ও পেশাদারিত্বের এক সমন্বিত অধ্যায়—তারই সফল সমাপ্তি ঘটল।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ লাইন্স সিভিক সেন্টারে আয়োজিত বিদায় সংবর্ধনায় পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের আবেগ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায় সিক্ত হন তিনি। বক্তৃতায়, উপহার-স্মারকে, স্মৃতিচারণে—সবখানে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব, কঠোর সিদ্ধান্তক্ষমতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং সহকর্মীদের প্রতি অবিচল মমতার স্মৃতি।
দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি। এক বছরেরও কম সময়ে তিনি যে পরিবর্তনের স্রোত বয়ে আনলেন—তা চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলার খাতায় নতুন করে লেখা থাকবে।
চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন মহাসড়ক, বাজার, জনপদ ও দুর্গম এলাকায় তিনি ব্যক্তিগতভাবে রাতভর টহলে অংশ নেন। অপরাধচক্রকে নিরুৎসাহিত করা, ডাকাতি প্রতিরোধ, দ্রুত নিরাপত্তা সাড়া নিশ্চিত করা—সবক্ষেত্রেই তাঁর নেতৃত্ব মাঠপর্যায়ের পুলিশকে সাহসী করে তোলে। নাগরিকরা বলেন,রাতে রাস্তায় পুলিশ সুপারের উপস্থিতি আমাদের নিরাপত্তার এক নতুন প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছে।

গোপন তথ্যের ভিত্তিতে একের পর এক অভিযানে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও ধারালো অস্ত্র। সন্ত্রাসী চক্রের ঘাঁটিতে অভিযান চালিয়ে তিনি ভেঙেছেন দুঃসাহসী অপরাধীদের নেটওয়ার্ক। এই কঠোর অবস্থানের কারণেই মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা তাকে ডাকতেন—(অপরাধীদের আতঙ্ক, জনগণের আশ্বাস)
জনগণের ভাষায় তিনি ছিলেন—চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীচক্রের কাছে ‘আজরাইল’ নামের এক প্রতীক।
মাদক চক্র শনাক্তকরণ, টার্গেটেড গ্রেফতার ও ধারাবাহিক বিশেষ অভিযান পরিচালনা—সব মিলিয়ে জেলার মাদকবাজদের ওপর চাপ বৃদ্ধি করতে মূল ভূমিকা পালন করেন তিনি। বহু মাদক বড়ি, ফেনসিডিল ও ইয়াবা উদ্ধার করে মাদক নেটওয়ার্ককে দুর্বল করে দেন।
গোয়েন্দা তথ্য, প্রযুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান ও সমন্বিত অভিযান—এই তিনের সমন্বয়ে বিদায়ী পুলিশ সুপারের সময়ে একাধিক চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উন্মোচিত হয় অল্প সময়ের মধ্যে। সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে আসে পুলিশি তদন্তে।
দীর্ঘমেয়াদি ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে তিনি পরিচালনা করেন কঠোর অভিযান। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এই উদ্যোগ নতুন মাত্রা এনে দেয়। বহুদিন ধরে লুকিয়ে থাকা কুখ্যাত আসামিরা আইনের আওতায় আসে।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নয়—পিতৃতুল্য অভিভাবক হিসেবে পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সদস্যদের পাশে।তিনি বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছেন—
বাসস্থানের মানোন্নয়ন
চিকিৎসা সুবিধা
মানসিক স্বাস্থ্য সংরক্ষণ
নিত্যপ্রয়োজনের দ্রব্য সরবরাহ
দায়িত্বের চাপ কমাতে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম
প্রশিক্ষণের সুযোগ সম্প্রসারণ
মাসিক কল্যাণ সভায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী হাতে হাতে তুলে দিয়েছেন। মাঠপর্যায়ের বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাৎক্ষণিক সম্মাননা দিয়েছেন—যা ফোর্সের মনোবল অনেক বাড়িয়েছে।
তিনি বিভিন্ন থানা, তদন্তকেন্দ্র, ফাঁড়ি ও ক্যাম্পে হঠাৎ পরিদর্শন করে মাঠফোর্সের বাস্তব অবস্থা জেনেছেন। অভিযোগ শুনেছেন সরাসরি, এবং অনেক সমস্যা সেখানেই সমাধান করে দিয়ে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আস্থা ও কর্মস্পৃহা সৃষ্টি করেছেন।
পুলিশ লাইন্স মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, পরিচ্ছন্নতা, আলো-বাতাস, শৃঙ্খলা ও ধর্মীয় পরিবেশকে আরও উন্নত করতে তিনি নেন বিশেষ উদ্যোগ। এর ফলে মসজিদটি সদস্যদের কাছে হয়ে ওঠে আরও মর্যাদাপূর্ণ ও শান্তিময়।
ফোর্সের জন্য নিয়মিত খেলাধুলা, শরীরচর্চা, আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কার্যক্রম চালু করেন তিনি।এতে পুলিশ সদস্যদের শারীরিক সক্ষমতা যেমন বেড়েছে, তেমনি মানসিক প্রশান্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে।
ছদ্মবেশে সাধারণ মানুষের অভিযোগ শোনা, রাতভর রাস্তায় থাকা, অসহায় মানুষের পাশে দাড়ানো—এসব কারণে তিনি জেলার বিভিন্ন স্থানে পরিচিত হয়েছেন মানবিক পুলিশ সুপার হিসেবে। তার কাজের ধরণ ছিল সহজ, আন্তরিক ও স্বচ্ছ। জনগণ তাকে পেয়েছে একজন নির্লোভ, জনবান্ধব ও সহমর্মী প্রশাসক হিসেবে।
অপরাধবিরোধী বার্তা, ট্রাফিক পরামর্শ, নিরাপত্তা নির্দেশনা, জরুরি সতর্কতা—এসব পোস্টের মাধ্যমে তিনি তৈরি করেন নাগরিক পুলিশের এক আধুনিক সেতুবন্ধন।
বিদায়ী ভাষণে পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলাম সানতু, বলেন, (চট্টগ্রামের মানুষের ভালোবাসা আমার কর্মজীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। এই জেলার প্রত্যেক মানুষ, প্রতিটি পুলিশ সদস্য—সবাইকে আমি অন্তরের গভীর থেকে শ্রদ্ধা জানাই)
সহকর্মীরা বলেন—“তিনি শুধু একজন কর্মকর্তা নন; তিনি একজন পথপ্রদর্শক, একজন অভিভাবক, একজন নেতা।”
চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলার খাতায় তাঁর ৩২৮ দিনের প্রতিটি দিনই দাগ কেটে যাবে—শৃঙ্খলা, সততা, দূরদর্শীতা ও মানবিকতার অক্ষয় স্মৃতি হয়ে। তিনি রেখে গেছেন দায়বদ্ধতা ও পেশাদারিত্বের এক মানদণ্ড—যা ভবিষ্যতের পুলিশ প্রশাসনের জন্য অনুকরণীয় হবে।



