
নিজস্ব প্রতিবেদক: পদবিতে কেউ উচ্চমান সহকারী, কেউ নিম্নমান সহকারী, আবার কেউবা বেঞ্চ সহকারী। সরকারি বেতন স্কেল অনুযায়ী মাস শেষে তাদের প্রাপ্তি বড়জোর ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অথচ জীবনযাপনে তারা হার মানান বড় শিল্পপতিদেরও। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এমন অনেক কর্মচারীর ঢাকায় রয়েছে একাধিক বহুতল ভবন, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং দামি ব্যক্তিগত গাড়ি। যেন আলাদীনের চরাগ হাতে পেয়েছেন তারা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া এসব কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা থাকলেও তদন্তের গতি অত্যন্ত ধীর। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন অধিকাংশ অভিযুক্ত।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাজউকের দুর্নীতির চিত্র নতুন কিছু নয়। এখানে চাকরি করে অবৈধ উপায়ে বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়াটা যেন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে এই কর্মচারীরা একা নন, তাদের পেছনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশ্রয় ও যোগসাজশ থাকে। এই পুরো সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় না আনলে দুর্নীতি রোধ করা অসম্ভব।’
রাজউকের উত্তরা জোনের তত্ত্বাবধায়ক এম এ বায়েজিদ খান। গত ১১ বছর ধরে একই জোনে কর্মরত। উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৬ নম্বর রোডে তার তিন কাঠার প্লটে রয়েছে ছয়তলা বাড়ি, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এছাড়া একই সেক্টরের ১২ নম্বর রোডে পাশাপাশি দুটি প্লট (২০ ও ২২ নম্বর) এক করে নির্মাণ করছেন ৯ তলা ভবন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেখানে একেকটি প্লটের দামই অন্তত ৬ কোটি টাকা। নিজের সম্পদের বিষয়ে বায়েজিদ খানের দাবি, তিনি একটি প্লট শ্বশুরবাড়ি থেকে এবং অন্যটি রাজউক কোটায় পেয়েছেন।
আরেক আলোচিত নাম অফিস সহকারী জাফর সাদিক। সম্প্রতি ডিবি পুলিশ তাকে আটক করার পর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, রাজধানীর আফতাবনগরে ‘নূর আহমেদ ভিলা’ নামে তার আটতলা বাড়ি এবং শান্তিনগরে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। প্লট বেচাকেনার দালালি ও নকশা পাসের ঘুষের টাকায় এসব সম্পদ গড়েছেন তিনি। অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় পুলিশ তাকে ছেড়ে দিলেও তার সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে।
ডাটা এন্ট্রি অপারেটর আবদুল মোমিনের মুগদায় রয়েছে সাততলা ভবন ‘শান্তির নীড় সুলতানা মহল’, যার আনুমানিক মূল্য ১০ কোটি টাকা। এছাড়া মতিঝিলের জসীম উদ্দীন রোডে ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ ভবনে তার দুটি ফ্ল্যাট এবং সাভারে দুই বিঘা জমির ওপর টিনশেড ঘর রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে এসব সম্পদ গড়েছেন।
নকশাকার এমদাদ আলীর বাড্ডা পুনর্বাসন প্রকল্পে ‘চাঁদপুর হাউস’ নামে ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। ডেমরাতেও তার দুটি প্লট থাকার অভিযোগ রয়েছে। পৈতৃক সূত্রে প্লট পাওয়ার দাবি করলেও সামান্য বেতনে কীভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করলেন, তার সদুত্তর মেলেনি।
চাকরির বয়স মাত্র চার বছর পেরোতেই ইমারত পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান দক্ষিণ পীরেরবাগে ২ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট এবং ব্যক্তিগত গাড়ি কিনেছেন। সেবাগ্রহীতাদের জিম্মি করে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
রাজউক শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও অফিস সহকারী নাসির উদ্দিন চৌধুরীর রাকিন সিটিতে দেড় কোটি টাকার ফ্ল্যাট ও বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। জালিয়াতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ১৬ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।
সহকারী অথরাইজড অফিসার আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নুর ইব্রাহীমপুরেই রয়েছে তিনটি বহুতল ভবন (৬ তলা ও দুটি ৯ তলা)। এর মধ্যে একটির নাম ‘হক হেরিটেজ’ এবং অন্যটি ‘ইবিএল বলাকা’। এফআর টাওয়ার ও বনানীর স্যারিনা হোটেলের নকশা জালিয়াতির মামলায় তিনি অভিযুক্ত। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন বলে জানা গেছে।
রাজউক শ্রমিক দলের সভাপতি ও সার্ভেয়ার মাসুম বিল্লাহর উত্তরায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের সাততলা বাড়ি রয়েছে। অবৈধ সম্পদের মামলায় তিনি কারাগারে থাকলেও রাজউক তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়নি।
এছাড়া বরখাস্তকৃত বেঞ্চ সহকারী বাশার শরীফের মানিকনগরে ফ্ল্যাট ও নোয়া গাড়ি; নিম্নমান সহকারী ইউসুফ মিয়ার গ্রামে তিনতলা বাড়ি ও গরুর খামার; সুপারভাইজার খালেদ মোশাররফ তালুকদারের বগুড়ায় বিলাসবহুল বাড়ি ও মাদারটেকে ফ্ল্যাট এবং অফিস সহকারী বেলাল হোসেন চৌধুরী রিপনের শান্তিনগর ও পূর্বাচলে প্লট-ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। নকশাকার শহীদউল্লাহ বাবু, শেখ ফরিদ, রেকর্ডকিপার মো. ফিরোজ ও হিসাব সহকারী মোহাম্মদ হাসানেরও ঢাকায় বাড়ি ও প্লট রয়েছে বলে জানা গেছে।
নিচতলার কর্মচারীদের এমন বিত্তবৈভব দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা। তিনি বলেন, ‘সচিব পদমর্যাদায় চাকরি করেও ঢাকায় আমার নিজের কোনো বাড়ি-ফ্ল্যাট নেই। সরকারি সুযোগ-সুবিধায় ঋণ নিয়ে বড়জোর একটি ফ্ল্যাট করা সম্ভব। কিন্তু তারা কীভাবে এসব সম্পদের মালিক হলেন, সেটা আমারও প্রশ্ন। রাজউকের যা অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছে আমাকেই পাবনায় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।’ অবসরের আগে বাকি দিনগুলো যেন সম্মানের সাথে পার করতে পারেন, সেজন্য তিনি সবার দোয়া চেয়েছেন।



