অনুসন্ধানঅপরাধআইন ও বিচারজাতীয়দুর্নীতিফিচারডবাংলাদেশ

কেরানি থেকে ডিএমপি কমিশনার; গণহত্যার আসামি হাবিবের পতন

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সামান্য তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে রাজনৈতিক জাদুবলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পুলিশের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী কর্মকর্তা। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি এবং বিরোধী মত দমনে সিদ্ধহস্ত এই কর্মকর্তা বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন পলাতক আসামি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গোপালগঞ্জের চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া হাবিবুর রহমানের উত্থান মূলত অন্ধ দলীয় আনুগত্যের ফসল। পিএসসির কেরানি পদে চাকরি করার সময় গোপালগঞ্জের আঞ্চলিক প্রভাব ও রাজনৈতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৯৮ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ঘনিষ্ঠভাজন হিসেবে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। পুলিশ বাহিনীতে দলীয়করণের সংস্কৃতি চালু করার পেছনে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।

মানবাধিকার সংস্থা ও নিরাপত্তা সূত্রের তথ্যমতে, ২০১৩ সাল থেকে প্রতিটি সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে হাবিবুর রহমান ছিলেন ‘খড়গহস্ত’। বিশেষ করে গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময় তিনি গণহত্যার অন্যতম নির্দেশদাতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের তদন্তে উঠে এসেছে, তার প্রত্যক্ষ নির্দেশেই রাজধানীর রামপুরা ও চানখাঁরপুল এলাকায় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয়, যাতে প্রাণ হারান বহু সাধারণ মানুষ।

ক্ষমতার দাপটে হাবিবুর রহমান গড়ে তুলেছিলেন দুর্নীতির এক বিশাল সাম্রাজ্য। পুলিশে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে তিনি হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থে সাভারে ‘হাবিব নগর’ ও ‘উত্তরণ পল্লী’ নামে দুটি বিশাল আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলেন। এছাড়া রাজধানী ও এর আশপাশে নামে-বেনামে জমি দখল ও কালো টাকার পাহাড় গড়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কাবাডি ফেডারেশনের অর্থ আত্মসাৎ, অপরাধী সিন্ডিকেট লালন-পালন এবং নারী কেলেঙ্কারিতেও তার নাম বারবার উঠে এসেছে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের প্রত্যক্ষ মদত তাকে করে তুলেছিল অপ্রতিরোধ্য।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই প্রভাবশালী কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান। গোয়েন্দা তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে তিনি ভারতে পালিয়ে আছেন। সেখানে বসেই পলাতক আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে তিনি দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কেরানি থেকে কমিশনার বনে যাওয়া হাবিবুর রহমান আজ ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রশাসনিক ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত এই কর্মকর্তার বিচার এখন সময়ের দাবি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button