নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১৫ মাস অতিক্রান্ত হলেও বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) প্রশাসনিক কাঠামোতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ এবং গোয়েন্দা সংস্থার নেতিবাচক প্রতিবেদন থাকা সত্ত্বেও বিগত সরকারের দোসর হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তারা ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো আঁকড়ে ধরে আছেন। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা স্বপদে বহাল থাকায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের পাশাপাশি পলাতক সাবেক প্রভাবশালীদের কাছে স্পর্শকাতর তথ্য পাচারের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং বিটিভির শীর্ষ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের ‘ম্যানেজ’ করেই এই চক্রটি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) এবং বিটিভির নিজস্ব তদন্তে এদের বিরুদ্ধে অনিয়মের পাহাড়সম প্রমাণ মিললেও, অদৃশ্য কারণে সেসব তদন্ত প্রতিবেদন সচিবালয়ের লাল ফিতায় আটকা পড়ে আছে।
সম্প্রতি বিটিভির কয়েকজন বিতর্কিত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলে এনএসআই ও দুদকের মতামত চাওয়া হয়। গত ৬ নভেম্বর এনএসআই মন্ত্রণালয়ে যে প্রতিবেদন জমা দেয়, তাতে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিটিভি সদর দপ্তরের জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মো. মনিরুল ইসলাম বিগত সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘স্টুডিওটেক’-কে কাজ পাইয়ে দিতে সিগন্যাল সিস্টেম ডিজিটালাইজেশন প্রকল্পে ব্যাপক কারচুপি করেছেন। কাজ শেষ না হতেই ঘুষের বিনিময়ে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মনিরুল ইসলাম পারিবারিকভাবে বিএনপি মতাদর্শী হওয়ার দাবি করে এখন ভোল পাল্টানোর চেষ্টা করছেন, যদিও তিনি মূলত আওয়ামী পন্থী কর্মকর্তা হিসেবেই পরিচিত।
নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রের নির্বাহী প্রযোজক সফির হোসাইন ওরফে ইলনের বিরুদ্ধেও উঠেছে ভয়াবহ জালিয়াতির অভিযোগ। গত ১৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া বিটিভির নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো সরকারি আদেশ ছাড়াই তিনি নিজেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দাবি করে নথিতে স্বাক্ষর করেছেন এবং বাজেটের অর্থ খরচ করেছেন। তদন্তকালে তিনি জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন, যা সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা বিধিমালার পরিপন্থী। তবুও তিনি বহাল তবিয়তে আছেন। এছাড়া একই কেন্দ্রের উপ-মহাপরিচালক (বার্তা) ড. সৈয়দা তাসমিনা আহমেদ ও অনুষ্ঠান নির্বাহী মাহবুবা ফেরদৌসের বিরুদ্ধেও অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ঢাকা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ সেলিমকে এনএসআই প্রতিবেদনে ‘মাহফুজা-জাহাঙ্গীর’ সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভুয়া ভাউচার তৈরি ও অনুমোদনহীন অনুষ্ঠানের নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দুদকের চিঠিতেও মনিরুল ইসলাম, জিল্লুর রশিদ ও আফিফা আফরোজের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মাহবুবা ফারজানার সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি এবং খুদে বার্তার জবাব দেননি। পরবর্তীতে তার একান্ত সচিব জানান, সচিব এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আলতাফ-উল-আলমও ‘মিটিংয়ে আছেন’ বলে বারবার এড়িয়ে যান। অভিযুক্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও সফির হোসাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে রাজি হননি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে এলেও রাষ্ট্রীয় এই গণমাধ্যমটিকে এখনো দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব হয়নি, যা সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি করেছে।



