ব্যস্ত শহরের কোলাহলে হারিয়ে যাওয়া মায়ের শেষ দোয়া (পর্ব-১: অনুশোচনার দহন)
সাহিত্য সাময়িকী: গ্রামের ছিমছাম প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা রাইয়ান ছিল সবার প্রিয়মুখ। সদা হাস্যোজ্জ্বল, কঠোর পরিশ্রমী এবং মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল যার একমাত্র পরিচয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দারিদ্র্য তাকে গ্রামছাড়া করে। জীবিকার তাগিদে সে পাড়ি জমায় যান্ত্রিক শহরে। শহরের ধুলোবালি আর কর্মব্যস্ততা খুব দ্রুতই গ্রাস করে নেয় গ্রামের সেই সহজ-সরল ছেলেটিকে। বদলে যেতে থাকে রাইয়ান, বদলে যায় তার সময় দেওয়ার অভ্যাস।
শহুরে জীবনে মানিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে প্রায় দু’মাস কেটে যায়। একদিন হঠাৎ মায়ের ফোন। ওপাশ থেকে ভেসে এল ব্যাকুল কণ্ঠস্বর, “বাবা, অনেক দিন তোর কোনো খবর পাই না। শরীরটা ভালো তো তোর?”
কাজের চাপে পিষ্ট রাইয়ানের কণ্ঠে তখন বিরক্তি। সে দ্রুত উত্তর দিল, “মা, এখন মিটিংয়ে আছি। পরে কথা বলব।” ফোনটা রেখে দেওয়ার পরপরই বিবেকের তাড়নায় ক্ষণিকের জন্য থমকে গিয়েছিল সে। নিজের অজান্তেই মায়ের সঙ্গে বড্ড রুক্ষ আচরণ করে ফেলেছে। মনকে সান্ত্বনা দিল এই বলে, “মা ঠিকই বুঝবে, দুনিয়াটা এখন এমনই ব্যস্ত।”
কিন্তু মা যে আর বোঝার সময় পাবেন না, তা কে জানত! সে রাতে মায়ের পাঠানো শেষ মেসেজটি ছিল— “বাবা, সাবধানে থাকিস। আজ তোর মঙ্গলের জন্য রোজা রেখেছিলাম, দোয়াও করেছি।” কাজের চাপে সেই মেসেজটি খোলারও সময় হয়নি রাইয়ানের।
ঘটনার এক সপ্তাহ পরের কথা। গ্রামের এক প্রতিবেশীর ফোনে আকাশ ভেঙে পড়ল রাইয়ানের মাথায়। “রাইয়ান, তোমার মা মৃত্যুশয্যায়। শেষবারের মতো একটু দেখে যাও।”
বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল তার। সব কাজ ফেলে রাতের ট্রেনেই গ্রামের পথ ধরল। ট্রেনের চাকার একঘেয়ে শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল তার হৃদস্পন্দন। মনের ভেতর শুধুই প্রশ্নের আনাগোনা— “সেদিন মায়ের সঙ্গে অমন ব্যবহার কি খুব জরুরি ছিল? মা কি আমাকে ক্ষমা করবে, নাকি অভিমান নিয়ে চলে যাবে?”
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রাইয়ান যখন বাড়ি পৌঁছাল, তখন মায়ের সময় ফুরিয়ে এসেছে। ছেলেকে দেখে ঘোলাটে চোখেও যেন প্রাণের সঞ্চার হলো। মা দুর্বল হাতটা বাড়িয়ে দিতে চাইলেন। রাইয়ান দৌড়ে গিয়ে মায়ের হাতটা আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল, “মা, আমাকে মাফ করে দাও। আমি বড্ড স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম।”
মৃত্যুপথযাত্রী মা কাঁপা কাঁপা গলায় ছেলেকে সান্ত্বনা দিলেন, “বাবা, মায়ের কি সন্তানের ওপর অভিমান সাজে? আমি শুধু চেয়েছি তুই ভালো থাক। শেষ রাতেও রবের কাছে বলেছি— আমার দোয়া যদি তোর কপালে না জোটে, তবে আল্লাহ যেন তোর জন্য হেদায়েতের আলো পাঠান।”
মায়ের হাতটা ক্রমশ শীতল হয়ে আসছিল। রাইয়ান মায়ের বুকে মাথা রেখে আর্তনাদ করে উঠল, “মা, আমাকে ছেড়ে যেও না। তুমি ছাড়া আমার যে কেউ নেই!” কিন্তু বিধাতার অমোঘ নিয়মে মায়ের চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। শেষ নিশ্বাসের সঙ্গে তিনি শুধু বলে গেলেন, “আল্লাহ তোকে দেখে রাখবেন, বাবা…”
বাইরে তখন ভোরের সূর্য উদিত হচ্ছে, কিন্তু রাইয়ানের পৃথিবী ডুবে গেল এক গভীর অন্ধকারে। মায়ের নিথর দেহের পাশে বসে সেদিন সে এক পরম সত্য উপলব্ধি করল— মায়ের দোয়া যার জীবন থেকে হারিয়ে যায়, সে আসলে পৃথিবীর সর্বস্ব হারায়।
অশ্রুসজল চোখে রাইয়ান প্রতিজ্ঞা করল, মায়ের সেই হারিয়ে যাওয়া দোয়ার ‘আলো’ তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। মা হয়তো নেই, কিন্তু তার দোয়ার প্রভাব নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও রয়ে গেছে। সেই আধ্যাত্মিক আলো আর মায়ের স্মৃতির সন্ধানে রাইয়ানের এক নতুন যাত্রা শুরু হলো আজ থেকে।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়…)



