আইন ও বিচারচট্টগ্রাম বিভাগদুর্নীতিদেশপ্রশাসনবিশেষ প্রতিবেদনব্রাহ্মণবাড়িয়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অপরাধের বিস্তার: নেপথ্যে ডিআইও-১ মহিদুলের ‘একচ্ছত্র আধিপত্য’ ও দুর্নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাজুড়ে খুন, দাঙ্গা, মাদক কারবার আর অস্ত্রের ঝনঝনানি যখন চরমে, সাধারণ মানুষের জানমাল যখন বিপন্ন, তখনো পুলিশের খাতায় পরিস্থিতি ছিল ‘স্বাভাবিক’। অভিযোগ উঠেছে, জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) চরম ব্যর্থতা এবং তৎকালীন ডিআইও-১ (জেলা ইন্টেলিজেন্স অফিসার) মোহাম্মদ মহিদুল ইসলামের সীমাহীন দুর্নীতিই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের চেয়ে নিজের আখের গোছাতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সদ্য বিদায়ী পুলিশ সুপার মো. এহতেশামুল হকের অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন ইন্সপেক্টর মহিদুল ইসলাম (বিপি-৭৯০৬১১৮১০৪)। অভিযোগ রয়েছে, এসপিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তিনি কার্যত জেলা পুলিশকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। তার প্রভাব এতটাই ছিল যে, অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে সমীহ করে চলতেন। পুলিশ সুপারের বদলির পরপরই নিজের অপকর্মের দায় এড়াতে তড়িঘড়ি করে বদলি নিয়ে জেলা ছেড়েছেন মহিদুলও। গত ২৬ নভেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরের আদেশে ৭৩ জন পরিদর্শকের মধ্যে ৩০ নম্বর ক্রমিকে থাকা মহিদুলকে রংপুর রেঞ্জে বদলি করা হয়েছে।

জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হলেও জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় মহিদুলের দেওয়া প্রতিবেদনে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের কলাম বরাবরই ফাঁকা থাকত। মাঠ পর্যায়ে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বাড়লেও তার গোয়েন্দা রিপোর্টে তার কোনো প্রতিফলন ছিল না। ভেরিফিকেশন ও অপরাধ দমনের রূপরেখা তৈরির বদলে ডিএসবি ব্যস্ত ছিল ভিন্ন কাজে।

পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, জেলার ৯টি থানা থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় ছিল মহিদুলের অন্যতম কাজ। এ কাজে তিনি ব্যবহার করতেন থানার কম্পিউটার অপারেটরদের। তার ইশারায় বিভিন্ন থানায় অফিসারদের অকারণে বদলি করা হতো, ফলে কেউ স্থির হয়ে কাজ করতে পারতেন না। এতে জেলায় ওয়ারেন্ট তামিল কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। অথচ ডিএসবি ও ডিবি শাখায় তার পছন্দের লোকজনকে তিনি বহাল তবিয়তে রেখেছিলেন।

নিজের ও পুলিশের অপকর্ম ধামাচাপা দিতে মহিদুল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও খড়গহস্ত ছিলেন। তার ব্যাচমেট ও আখাউড়া ইমিগ্রেশন ইনচার্জ আবদুস সাত্তার এবং আখাউড়া থানার ওসি ছমি উদ্দিনের মাধ্যমে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের হয়রানি করতেন। ইমিগ্রেশনের অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় এসপির মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশন ইনচার্জকে দিয়ে চাঁদাবাজির মামলা করান তিনি। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা সভায় পুলিশের সমালোচনা করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ঢাকায় ‘গোপন নেতিবাচক প্রতিবেদন’ পাঠানোর ভয়ও দেখাতেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানা সংলগ্ন পুলিশ ক্লাবের নিচতলার দুটি কক্ষ নিজের লোকদের ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে মাসিক ৩ হাজার টাকা ভাড়ায় অলিখিত বরাদ্দ দিয়েছিলেন মহিদুল। এছাড়া পুলিশ লাইন্সের কেনাকাটা ও নিয়ন্ত্রণে এএসআই রবিউলকে ব্যবহার করতেন তিনি। প্রশাসনিক কারণে রবিউলের বদলি আদেশ এলেও মহিদুলের প্রভাবে তা আটকে যেত। আরআই ফখরুলও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

জেলায় এমন অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি ও নানা অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডিআইও-১ মহিদুল ইসলামের সরকারি ও ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি বলেন, “ফোনে কোনো কিছু বলা যায় না, কবে আসবেন বলেন।”

এ বিষয়ে জেলা পুলিশের বক্তব্য জানতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আবু সাঈদ মো. গাউসল আজম এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. ওবায়দুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।

এসপির বদলির পর মহিদুলের বিদায়ে জেলা পুলিশের অনেক কর্মকর্তাই এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাদের মতে, গত এক বছরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মূল দায় এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button