দেশমতামতরাজশাহী বিভাগসম্পাদকীয়

মা কুকুরের হাহাকার: মানবতা যেখানে পরাজিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঈশ্বরদীতে আটটি সদ্যোজাত কুকুরছানাকে বস্তাবন্দি করে পুকুরে ডুবিয়ে হত্যার ঘটনাটি আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজের মুখে এক সজোরে চপেটাঘাত। মা কুকুরটির সেই গগনবিদারী আর্তনাদ দেখে আজ প্রশ্ন জাগে—মানুষের আকৃতি পেলেই কি মানুষ হওয়া যায়? নাকি বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড নামের যে মাংসপিণ্ডটি ধুকপুক করে, তা কেবলই বেঁচে থাকার যান্ত্রিকতা, যেখানে আবেগ বা বিবেকের কোনো স্থান নেই?

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন মানুষের মাঝে লুকিয়ে থাকা পশুত্বের কথা। ঈশ্বরদীর ঘটনাটি যেন সেই পংক্তিরই নির্মম বাস্তবায়ন। যে নিষ্ঠুরতায় আটটি নিষ্পাপ প্রাণকে হত্যা করা হয়েছে, তা কোনো সাধারণ অপরাধ নয়; এটি মানবিক অবক্ষয়ের চরম সীমা। মা কুকুরটি যখন সন্তান হারিয়ে পাগলের মতো ছুটছিল, তার সেই কান্না কোনো নির্দিষ্ট প্রাণীর ছিল না; সেটি ছিল বিশ্বজনীন মাতৃত্বের হাহাকার। প্রকৃতির সেই বুকফাটা শোকের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, আমরা মানুষ হিসেবে জন্ম নিলেও ‘মন’ নিয়ে জন্মাতে পারিনি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “অন্যায়ের যে করে প্রতিকার, অন্যায়ের যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।” আজ মনে হচ্ছে, আমরা সেই অন্যায়ের নীরব সাক্ষী। ওই অবলা প্রাণীগুলোর কী অপরাধ ছিল? তারা তো কারও সম্পদ লুট করেনি, কারও ক্ষতি করেনি। তারা শুধু এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে একটু বাঁচার অধিকার চেয়েছিল, মায়ের উষ্ণতায় নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছিল। অথচ মানুষের নিষ্ঠুর হাত তাদের সেই অধিকার কেড়ে নিতে একটুও কাঁপেনি।

আদিম যুগে যখন মানুষের ভাষা ছিল না, আগুন ছিল না, তখনও তারা মাতৃত্বের ভাষা বুঝত। বনের পশুপাখির প্রতিও তাদের একধরনের মায়া ছিল। আর আজ সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছে আমরা কতটা নিচে নেমেছি? মুখে ধর্মের বুলি আউড়ে, মানবতার স্লোগান দিয়ে আমরাই আবার নির্মমভাবে প্রাণ হত্যা করছি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, মানুষ যখন তার মহিমা হারায়, তখন সে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে পড়ে।

ঈশ্বরদীতে পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে, এটি আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু আদালতের বিচারের চেয়েও বড় বিচার হলো বিবেকের আদালতে। একজন ব্যক্তির এই জঘন্য কাজের দায় কি পুরো সমাজ এড়াতে পারে? আমরা কি সত্যিই একটি মানবিক সমাজ গড়তে পেরেছি, নাকি আধুনিকতার মোড়কে বর্বরতাকে লালন করছি?

একটি কুকুরছানাকে সামান্য খাবার বা আশ্রয় দিলে তারা কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করে। ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবী জয় করা যায়, নিষ্ঠুরতা দিয়ে নয়। আজ যারা কুকুরছানা হত্যায় মেতেছে, কাল তারা মানুষের ওপর চড়াও হবে না—তার নিশ্চয়তা কী? নিষ্ঠুরতার কোনো সীমানা নেই।

এই নির্মম ঘটনার বিচার আমরা চাই। তবে সেই বিচার শুধু আইনের ধারায় নয়, হতে হবে নৈতিকতার মানদণ্ডে। মা কুকুরটির কান্নার দায় আমাদের সবার। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আসুন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি—আমরা কি আসলেই মানুষ, নাকি মানুষের মুখোশ পরা অন্য কিছু? বিবেক জাগ্রত হোক, নতুবা সভ্যতার মানচিত্রে আমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button