ইতিহাস ও ঐতিহ্যজাতীয়দেশমতামতরাজনীতিসংগৃহীত সংবাদ

বঙ্গবন্ধু ও মেজর ডালিম প্রসঙ্গ: প্রোপাগান্ডা বনাম ঐতিহাসিক বাস্তবতার বিশ্লেষণ

নিজস্ব প্রতিবেদক: ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোনো মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ছড়ানো প্রোপাগান্ডা অনেক সময় ইতিহাসের সত্যকে আড়াল করে দেয়। সম্প্রতি মেজর ডালিম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে চলা বিতর্ক এবং ঐতিহাসিক তথ্যাবলি নতুন করে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

মেজর ডালিম প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সত্য হলো, তিনি একজন ‘বীর উত্তম’ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং এই খেতাবটি খোদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারই তাঁকে প্রদান করেছিল। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনায় মেজর ডালিমের ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা থাকলেও, জানা যায় তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সরাসরি হামলায় অংশ নেননি। এর মূল কারণ ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক। ডালিমের পরবর্তী স্বীকারোক্তি থেকে স্পষ্ট হয় যে, বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ২৫ বছরের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, কিন্তু জিয়াউর রহমানের কৌশলের কারণে তাদের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেসব নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হয়, তার বিপরীতে যৌক্তিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তিও প্রবল।
প্রথমত, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ও প্রচেষ্টা একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানেরই ছিল। নেতৃত্বের ধরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রনায়করা সশরীরে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করেন না, বরং তাদের নির্দেশনায় যুদ্ধ পরিচালিত হয়। যেমন—ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন বা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি, কিন্তু তাদের নেতৃত্বেই সংঘাত বা যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ উপাধি দেওয়ার বিষয়টি স্বাধীনতার পূর্বেই মীমাংসিত। ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী, আ স ম আবদুর রব স্বাধীনতার আগেই তাঁকে এই উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

তৃতীয়ত, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যে ‘দাসত্ব’র অভিযোগ তোলা হয়, তা ভিত্তিহীন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত যে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল, তার প্রতিদান এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বাস্তবতায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে কিছু সুবিধা দিতে হয়েছিল। একে কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা বলা যেতে পারে, দাসত্ব নয়।

চতুর্থত, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে অপপ্রচার ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাক রয়েছে। এই দুর্ভিক্ষের জন্য এককভাবে বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করা হলেও, এর পেছনে মূলত দায়ী ছিল কালোবাজারি, মজুতদার ও চোর চক্র। যদিও সরকারি অব্যবস্থাপনার দায় অস্বীকার করার সুযোগ নেই এবং লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, তবুও মৃতের সংখ্যা নিয়ে ১৫ লাখের যে বয়ান দেওয়া হয়, তা অতিরঞ্জিত। যারা মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং জানতে চান কার গ্রামে কতজন শহীদ হয়েছেন, তাদের উদ্দেশে পাল্টা প্রশ্ন রাখা যায়—৭৪-এর দুর্ভিক্ষে তাদের নিজ এলাকায় কতজন অনাহারে মারা গিয়েছিলেন?

ইতিহাসের এসব অমীমাংসিত অধ্যায় আবেগের চেয়ে যুক্তির নিরিখে বিচার করা জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button