সুখ কুক্ষিগত করার নয়, ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়: মোল্লা নাসিরুদ্দিনের জীবনদর্শন

নিজস্ব প্রতিবেদক: গ্রামের শেষ বিকেলের আড্ডা তখন জমজমাট। চায়ের ধোঁয়া ওঠা কাপের সঙ্গে চলছে নানা গল্প। আর সেই আড্ডার প্রাণপুরুষ হলেন মোল্লা নাসিরুদ্দিন। সাদা দাড়ি আর হাস্যোজ্জ্বল মুখের মোল্লা নাসিরুদ্দিনের কথা শোনার জন্য গ্রামের মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকে। জটিল সব সমস্যার সমাধান তিনি দেন অত্যন্ত সহজ ভাষায়, যা শুনলে মনে হয়—সত্য তো চোখের সামনেই ছিল!
এমনই এক সন্ধ্যায় সেই চায়ের আড্ডায় এসে হাজির হলেন এলাকার প্রবল প্রতাপশালী ও বিত্তবান ব্যবসায়ী হাজি করিম। বিত্তবৈভব, অট্টালিকা, সফল সন্তান—কিছুরই কমতি নেই তার জীবনে। কিন্তু আজ তাকে বড় বেশি বিষাদগ্রস্ত দেখাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাজি সাহেব মোল্লার কাছে নিজের অন্তরের হাহাকার প্রকাশ করলেন। জানালেন, জাগতিক সব পাওয়ার পরেও তার মনে শান্তি নেই, রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না। সুখ যেন তার কাছ থেকে যোজন যোজন দূরে।
সব শুনে মোল্লা নাসিরুদ্দিন কোনো তাত্ত্বিক কথা না বলে দোকানের কোণ থেকে একটি মাটির প্রদীপ তুলে নিলেন। প্রদীপের শিখা জ্বলে উঠতেই চায়ের দোকানের অন্ধকার কোণ আলোকিত হয়ে উঠল। মোল্লা বিত্তবান হাজি সাহেবকে প্রশ্ন করলেন, “এই যে আলো দেখছেন, যা আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করেছে—এটি কি আপনি পকেটে পুরে একা বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন?”
হাজি করিম মোল্লার প্রশ্নে অবাক হয়ে হেসে বললেন, “তা কী করে সম্ভব! আলো তো পকেটে বন্দি করার জিনিস নয়। আলো ছড়িয়ে দিতে হয়। আটকে রাখলে তো তা নিভে যাবে।”
মোল্লা নাসিরুদ্দিন তখন গভীর প্রত্যয়ে বললেন, “ঠিক তাই। সুখও ঠিক এই প্রদীপের আলোর মতোই। আপনি যতই ধন-সম্পদ নিজের জন্য জমিয়ে রাখুন না কেন, তা আপনাকে শান্তি দেবে না। কারণ সুখ আটকে রাখার বিষয় নয়, এটি ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়।”
মোল্লা তাকে পরামর্শ দিলেন, নিজের সঞ্চিত সম্পদ আঁকড়ে না ধরে সমাজের অসহায়, এতিম ও দুস্থদের মাঝে বিলিয়ে দিতে। অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে পারলে সেই সুখের আভা নিজের মনেও প্রশান্তি বয়ে আনবে।
মোল্লার সেই কথা হাজি করিমের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। তিনি অশ্রুসজল চোখে মোল্লাকে আলিঙ্গন করেন। এরপর থেকে পুরো গ্রামের চিত্রই বদলে যায়। যে হাজি সাহেব একসময় নিজের বিষণ্নতা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, তিনিই শুরু করলেন জনহিতকর কাজ। এতিমখানা প্রতিষ্ঠা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা এবং ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাবারের আয়োজন করে তিনি হয়ে উঠলেন এক নতুন মানুষ। গ্রামবাসী লক্ষ্য করল, হাজি সাহেবের মুখে এখন আর আঁধার নেই, বরং সেখানে লেগে আছে এক প্রশান্তির জ্যোতি।
আর মোল্লা নাসিরুদ্দিন? তিনি আগের মতোই চায়ের দোকানে বসে বলেন, “জীবন তো আলোর মতোই, যত বিলিয়ে দেবে, ততই তুমি ফিরে পাবে।”
শিক্ষা: নিজের ঝুলিতে সুখ জমা করা যায় না, বরং অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিলেই প্রকৃত সুখের সন্ধান মেলে।



