অপরাধদেশপরিবেশবিশেষ প্রতিবেদন

কুমিল্লায় গোমতীর বুক চিরে চলছে মাটির ‘হরিলুট’: ঝুঁকিতে বাঁধ ও জনপদ

মুহাম্মদ জুবাইর: কুমিল্লার গোমতী নদীর দুই পাড় যেন এখন এক উন্মুক্ত খনি। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে মাটি কাটার এক মহোৎসব। স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে নদীর চর ও বাঁধ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। এতে করে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের শঙ্কার পাশাপাশি চরম ঝুঁকিতে পড়েছে বাঁধ, সড়ক, সেতু এবং হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমি।

সরেজমিনে দেখা যায়, গোমতী নদীর প্রায় ৯০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে এই ধ্বংসযজ্ঞ। নদীর দুই পাড়ের অন্তত ৮৭টি পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন ১৪০০ থেকে ১৫০০ ট্রাক মাটি কেটে বিভিন্ন ইটভাটায় পাচার করা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলছে এই অবৈধ কর্মযজ্ঞ। প্রশাসনের অভিযানের খবর পেলেই সিন্ডিকেট গা ঢাকা দেয়, আর অভিযান শেষ হলেই পুনরায় শুরু হয় মাটির লুটপাট।

বুড়িচং, মুরাদনগর, দেবিদ্বার ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বিভিন্ন অংশে এই চিত্র ভয়াবহ। বিশেষ করে টিক্কার চর, শুভপুর, জগন্নাথপুর, বিবির বাজার, চাঁন্দপুর ব্রিজ এবং আলেখারচর এলাকায় মাটি খেকোদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। ট্রাকের অবাধ চলাচলের কারণে ধুলায় ধূসরিত হয়ে পড়েছে গ্রামের পর গ্রাম। এতে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আর্তনাদ থামছেই না। গোমতী চরের প্রায় ৩ হাজার হেক্টর উর্বর জমিতে প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদিত হয়। এক কৃষক আক্ষেপ করে বলেন, “আগে যেখানে টমেটো আর সবজি চাষ করতাম, আজ সেখানে বড় বড় গর্ত। রাতের আঁধারেই জমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। আমাদের চাষাবাদের কোনো জায়গা আর অবশিষ্ট নেই।”

ট্রাক চালকদের সূত্রে জানা যায়, শুধু বুড়িচংয়ের একটি ইটভাটাতেই (এমরান ব্রিকস) প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ ট্রাক মাটি সরবরাহ করা হচ্ছে। অবৈধভাবে মাটি কাটার ফলে বাঁধ ও ব্রিজের গোড়া নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, যা বর্ষাকালে বড় ধরণের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।

এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তানজিনা জাহান বলেন, “অবৈধ মাটি কাটা বন্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা নিয়মিত জরিমানা করছি এবং একটি শক্ত কমিটি গঠন করে তদারকি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।”

স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি, লোক দেখানো অভিযান নয়, গোমতী নদী ও কুমিল্লা শহরকে বাঁচাতে হলে এখনই কঠোর ও স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে গোমতীর চরের উর্বর কৃষি জমি এবং হুমকির মুখে পড়বে হাজারো মানুষের জীবন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button