আন্তর্জাতিকইতিহাস ও ঐতিহ্যফিচারড

বিলাসিতা আর পাপাচারেই কি ধ্বংস হয়েছিল ২১০০ বছর আগের সেই আধুনিক পম্পেই?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইতালির মানচিত্রে তখন পম্পেই এক জৌলুসপূর্ণ নাম। সময়টা আজ থেকে প্রায় ২১০০ বছর আগে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ১০০ সালের কাছাকাছি। ভিসুভিয়াস পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা এই জনপদ ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম ধনী ও আধুনিক শহর। কিন্তু কে জানত, এই জৌলুস আর অবাধ বিলাসিতাই একদিন ইতিহাসের পাতায় শহরটিকে ‘অভিশপ্ত নগরী’ হিসেবে চিহ্নিত করবে!

সে সময় পম্পেই কোনো ধ্বংসস্তূপ ছিল না, বরং ছিল প্রাণের স্পন্দনে ভরপুর। রোমান সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্যকেন্দ্রে ধনী ব্যবসায়ী, সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের আনাগোনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। শহরের অর্থনীতি ছিল দারুণ চাঙ্গা; বিশেষ করে মদের ব্যবসা, জলপাই এবং একধরণের বিশেষ মাছের সস (Garum) ছিল তাদের আয়ের মূল উৎস।

পম্পেইয়ের জীবনযাত্রা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের আধুনিক। আজ আমরা যেসব নাগরিক সুবিধার কথা ভাবি, ২১০০ বছর আগেও পম্পেইতে তা বিদ্যমান ছিল। পাথর বাঁধানো প্রশস্ত রাস্তা, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, এমনকি শহরের প্রতিটি প্রান্তে পানির পাইপলাইন—সবই ছিল তাদের। বিনোদনের জন্য ছিল বিশাল থিয়েটার, স্টেডিয়াম এবং শরীরচর্চা ও আড্ডার জন্য পাবলিক বাথ বা স্নানাগার। সে সময়ের নারীরাও যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতেন এবং ব্যবসার কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন।

শহরটির ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি। কিন্তু দীর্ঘকাল কোনো অগ্ন্যুৎপাত না হওয়ায় মানুষ ভুলেই গিয়েছিল যে, এটি একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। এই ‘ঘুমন্ত’ পাহাড়ের ছায়ায় তারা নিশ্চিন্তে গড়ে তুলেছিল বিলাসী জীবনের এক স্বর্গরাজ্য।

তবে পম্পেইয়ের এই চাকচিক্যের আড়ালে ছিল এক অন্ধকার অধ্যায়, যা ইতিহাসবিদদের কাছে আজও বিস্ময়ের। রোমান সংস্কৃতির অংশ হলেও সে সময়ের পম্পেইতে নৈতিকতার বাঁধন ছিল অত্যন্ত শিথিল। শহরটিতে প্রচুর পরিমাণে লুপানার (Lupanar) বা যৌনালয়ের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উঠে এসেছে অসংখ্য অশ্লীল দেয়ালচিত্র ও মোজাইক, যা ঘরের শোবার ঘর থেকে শুরু করে রাজপথ, এমনকি উপাসনালয়েও দেখা যেত।

তৎকালীন পম্পেই সমাজ ছিল চরম ভোগবাদী। ধনীরা মদ্যপান, উদ্দাম পার্টি আর অনৈতিক সম্পর্কে মজে থাকত। রাস্তায় বা স্নানাগারে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ ছিল খুবই সাধারণ বিষয়। এমনকি দাস-দাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক এসব কাজে ব্যবহার করা হতো, যা বর্তমান সভ্যতার দৃষ্টিতে চরম অমানবিক। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেও ছিল যৌনতার ছড়াছড়ি; বিশেষ করে প্রজনন দেবী ভেনাসের পূজায় নগ্নতা ও কামুকতা ছিল স্বাভাবিক অনুষঙ্গ।

অবশেষে ৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকৃতির প্রতিশোধের মতো জেগে ওঠে ভিসুভিয়াস। মাত্র ২৪ ঘণ্টার প্রলয়ঙ্করী অগ্ন্যুৎপাতে ছাই আর পাথরের নিচে চাপা পড়ে পুরো শহর। হাজার হাজার মানুষ মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

ইতিহাসের পাতায় আজও পম্পেইয়ের এই করুণ পরিণতির কারণ হিসেবে অনেকে এর ‘নৈতিক অবক্ষয়’কে দায়ী করেন। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে এটি একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তবুও সমসাময়িক অনেকের মতে, পম্পেইয়ের লাগামহীন পাপাচার ও অশ্লীলতাই তাদের ওপর এই ‘ঐশ্বরিক গজব’ ডেকে এনেছিল। পাপের নগরী হিসেবে খ্যাত পম্পেই তাই আজও এক রহস্যময় ও শিক্ষণীয় ইতিহাসের সাক্ষী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button