চট্টগ্রামে ‘অপরাধ জগতের ডন বাদশা’ পাপ্পী এখন কানাডায় পলাতক অভিযোগের পাহাড়ে অস্থির বোয়ালখালী

মুহাম্মদ জুবাইর
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থেকে কানাডা পর্যন্ত বিস্তৃত অভিযোগের ঝড় মনসুর আলম পাপ্পীকে ঘিরে জনপদে আতঙ্ক প্রশাসনে নীরবতা ভুক্তভোগীদের কান্না
এই পাপ্পির অপকর্মের মূল হোতা বর্তমানে রোকন মামুন শিশির।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী কর্ণফুলী কালুরঘাট এবং শহরের বিভিন্ন এলাকায় বছরের পর বছর ধরে জাল সনদ, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়া, বিদেশ ভিসায় জালিয়াতি, অবৈধ বালু উত্তোলন, নদীর ঘাট দখল, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো ভয়ভীতি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, জমি দখল, হত্যাকাণ্ড এবং ড্রেজারের যন্ত্রপাতি আত্মসাতের চেষ্টার মতো বহুমাত্রিক বিস্ফোরক অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মনসুর আলম পাপ্পীকে ঘিরে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে জনমত যদিও এসব অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি। স্বতন্ত্রভাবে যাচাইও হয়নি তবে স্থানীয়দের বর্ণনা মামলা নথি অভিযোগকারীদের আবেদন এবং সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতাই চট্টগ্রামের জনপদে ভয় আতঙ্ক ক্ষোভ আর বঞ্চনার অন্ধকার ছবি ফুটিয়ে তুলেছে পাপ্পীর বিরুদ্ধে ,চুরির পুরোনো মামলা, ড্রেজার দখল চেষ্টার মামলা পুলিশ পরিচয়ে ভয়ভীতি ছড়ানো এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মামলার বাদিকে হুমকি প্রদানের অভিযোগ উঠেছে নতুন করে জাল সনদ দিয়ে বিদেশ ভিসা নেওয়া এবং বিদেশে বসেও হুমকি ধামকি দেওয়ার অভিযোগ যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে জুলাই আন্দোলনের সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ ভুক্তভোগীদের অভিযোগও পাপ্পীর প্রভাববলয়ের দিকে আঙুল তুলেছে অন্যদিকে গ্রেফতার এড়াতে এবং ধারাবাহিক অভিযোগ থেকে দূরে থাকার অভিযোগে কানাডায় অবস্থান করলেও স্থানীয়দের দাবি তিনি এখনো শক্ত প্রভাব বজায় রেখেছেন তার ব্যবসায়িক ম্যানেজার শিশির মামুন রোকনের মাধ্যম দিয়ে ভয়ভীতি পাঠান ।একই সময়ে কালুরঘাট এলাকার সংবেদনশীল অংশে বালু উত্তোলনের অভিযোগ বহুবার উঠেছে যেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষ বা জেলা প্রশাসন কোনো অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও ঘাট বন্ধ করে বালু তোলা হয়েছে এমন দাবি করেছে স্থানীয়রা ।এসব অভিযোগের সত্যতা তদন্ত ছাড়া নিশ্চিত বলা সম্ভব নয় তবে বহু বছরের জমে থাকা অভিযোগ প্রশাসনিক নীরবতা এবং প্রভাবশালী চক্রের আধিপত্য মিলিয়ে বোয়ালখালীতে জনমনে এক অদৃশ্য শঙ্কা তৈরি করেছে আজ স্থানীয়দের একটাই দাবি আইনের শাসন ফিরুক তদন্ত হোক বিচার হোক এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে কোনো অপরাধই যেন আর ক্ষমতা না পায় ।
চট্টগ্রামের সদ্য আলোচিত মামলাগুলোর মধ্যে পুলিশ পরিচয়ে চুরির চেষ্টা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হুমকি প্রদানের অভিযোগ আবারও তীব্র আলোচনা তৈরি করেছে তাদের ঘিরে মনসুর আলম পাপ্পী ঝ তার ভাই মোহাম্মদ আলম ববি এবং বাপ্পির ম্যানেজার শিশির মামুন রোকন। হাসান বিল্ডার্সের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান সম্প্রতি চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনালে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ২৯ এবং ৩৫ ধারায় মামলা দায়ের করেছেন। বাদির অভিযোগ অনুযায়ী কালুরঘাটের ড্রেজার সাইট থেকে পুলিশ পরিচয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে যন্ত্রপাতি চুরির চেষ্টা করা হয় এবং ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে হাতেনাতে আটক করা হয়। পাঁচজনকে আসামি করে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয় জামিনে বের হয়ে মনসুর আলম পাপ্পী এবং মোহাম্মদ আলম ববি বাদির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ছড়ান এবং হুমকি দেন। এই অভিযোগ এখন তদন্তাধীন এবং আদালত পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তদন্তই যেন ছিল ক্ষমতার কাছে দিশেহারা।
বছরের পর বছর অভিযোগের পাহাড় জমা হলেও মনসুর আলম পাপ্পীর নাম বারবার উঠে এসেছে নানা আলোচনায়। তার বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে বোয়ালখালী থানায় চুরির অভিযোগে একটি মামলা এবং ২০১১ সালে রাজধানীর নিউমার্কেট থানায় আরেকটি চুরির মামলা হয়েছিল বলে নথিতে পাওয়া গেছে। পাশাপাশি কর্ণফুলী এবং হালদা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন এবং এর নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে একাধিক সহিংস ঘটনার অভিযোগও স্থানীয়দের দাবি হিসেবে উঠেছে যদিও এসব অভিযোগের অনেকগুলোই এখনো তদন্ত বা বিচারাধীন তাই কোনোটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত নয়। কিন্তু প্রভাব বলয়ের বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের বর্ণনায় উঠে আসে দীর্ঘদিন ধরে একটি অদৃশ্য শক্তি এলাকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
কালুরঘাট এলাকায় বালু উত্তোলন নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ উঠেছিল যেখানে সেতু পাম্প হাউস এবং পাইপলাইন সংলগ্ন সংবেদনশীল এলাকায় অনুমতি ছাড়া বালু তোলা হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছিলেন। বালু উত্তোলনের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ বা জেলা প্রশাসনের কোনো ইজারা না থাকা সত্ত্বেও সেখানে বিশাল বালুর স্তূপ দেখা যেত। অভিযোগকারীরা দাবি করেন এসব বালু ভবন নির্মাণ ব্রিজ কালভার্টসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতো এবং প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা অবৈধ আয় হতো এই ব্যবসা থেকে। স্থানীয়দের মতে পুরো এলাকায় বালুর ব্যবসা ছিল একটি চক্রের নিয়ন্ত্রণে।
এভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগে সরকারের বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হওয়ার কথা স্থানীয়রা বললেও অভিযুক্ত পক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন তারা কখনো অবৈধ ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন না। তবে স্থানীয়দের বর্ণনায় মনসুর আলম পাপ্পীর বিরুদ্ধে নামে বেনামে সম্পদ গড়ার অভিযোগও পাওয়া যায় যেখানে জমি প্লট ফ্ল্যাট এমনকি বিশাল জমিতে বাগানবাড়ি নির্মাণের কথাও বলা হয়। পরিবারের সাথে নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণ এবং একাধিক গাড়ি ব্যবহার দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা ইত্যাদি বিষয় স্থানীয়দের কাছে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে এসেছে যদিও এসব সম্পদের উৎস বা বৈধতার বিষয়ে আদালত বা কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত দেয়নি।
বোয়ালখালী এবং আশপাশের এলাকায় ভয়ভীতিমূলক পরিবেশ তৈরি হওয়ার অভিযোগও বারবার উঠেছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে হস্তক্ষেপ করা প্রকল্পে সরঞ্জাম সরবরাহের দাবি আদায় করা এবং অস্বীকার করলে পরিণতি ভোগ করতে হয় এমন অভিযোগ বহু মানুষের মুখে শোনা গেছে। কালুরঘাট এলাকায় নির্মিত হতে যাওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির মাটি ভরাটের কাজও চাপ তৈরি করে আদায় করা হয়েছিল বলে স্থানীয়দের দাবি। এসব অভিযোগের সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই হয়নি তবে অভিযোগকারীরা বহুদিন ধরে দাবি করে আসছেন তারা নিরপেক্ষ তদন্ত চান।
একাধিক হত্যাকাণ্ডের সাথেও তার নাম ওঠার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের কথায়। সিডিএর অনন্যা আবাসিক প্রকল্পে বিরোধকে কেন্দ্র করে শীর্ষ সন্ত্রাসী আজিম উদ্দিন মাহমুদ অপহরণ এবং গুমের ঘটনায় মনসুর আলম পাপ্পী এবং তার ভাই মোহাম্মদ আলম ববির নাম এজাহারে ছিল। পাশাপাশি সাইফুল মেম্বার হত্যা কামাল মেম্বার হত্যা এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবদুল হাকিম হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও উঠে এসেছে যার বিচারিক প্রক্রিয়া এখনো সম্পন্ন হয়নি। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যায় না।
রাজনৈতিক পরিচয়ও বহু ক্ষেত্রে আলোচনার বিষয় হয়েছে। এলাকায় প্রভাবশালী অবস্থানকে শক্তিশালী করতে মনসুর আলম পাপ্পী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি পদ পান। পরবর্তীতে পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য প্রচার এবং পোস্টারও দেখা গেছে তখন। স্থানীয়দের অভিযোগ রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহারের কারণেই বহু অভিযোগ সঠিকভাবে তদন্ত হয়নি যদিও এসব অভিযোগের স্বাধীন মূল্যায়ন এখনো হয়নি।
সম্প্রতি তিনি কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেলেও স্থানীয়দের মতে তিনি বিদেশ থেকে ফোন বা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করেন এমন অভিযোগ উঠেছে। জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ভুক্তভোগী নাঈমুল রহমান রাব্বি দাবি করেছেন ওই দিনের সংঘর্ষে প্রভাবশালী ব্যক্তির ক্যাডার বাহিনী অস্ত্র নিয়ে অংশ নিয়েছিল এবং তার ওপর গুলির দায় খুঁজে বের করতে হবে। তিনি বিদেশি মিশন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এবং প্রশাসনের কাছে আবেদন দিয়েছেন জাল সনদ ব্যবহার করে বিদেশে ভিসা প্রাপ্তি এবং ওই ব্যক্তিকে দেশে এনে বিচার করার দাবি জানিয়েছেন। এসব অভিযোগ আদালত বা সংশ্লিষ্ট দেশের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যাচাই হয়নি।
ড্রেজার সরঞ্জাম দখল এবং ভয়ভীতি নিয়ে নতুন মামলা যুক্ত হয়েছে যার বাদী সাবেক মেরিন কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন হাফিজ আদালতে অভিযোগ করেন চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ ফেরত না দিয়ে দখলে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। পুলিশ দুটি ড্রেজার এবং যন্ত্রাংশ উদ্ধার করেছে। তবে অভিযুক্ত পক্ষ এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে। নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক দুইজন ভুক্তভোগী জানান এই পাপ্পি একজন প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য, বছরের পর বছর মানুষকে জিম্মি করে সরকারি চাকরির নামে হাতিয়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
বহু বছরের অভিযোগ প্রশাসনের নীরবতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের মনে ক্ষোভ জমেছে। তাদের দাবি আইন সবার জন্য সমান রাজনৈতিক পরিচয় কোনো ঢাল হতে পারে না বিদেশে থাকার মানে এই নয় যে অভিযোগের বিচার এড়ানো যাবে। বোয়ালখালীর মানুষ বলছেন দীর্ঘদিন ধরে ভয় এবং আতঙ্কে তারা মুখ খুলতে পারেননি এখন অভিযোগগুলো বিচারিক প্রক্রিয়ায় আসায় তারা আশাবাদী।
সব অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ এখন আদালত তদন্ত সংস্থা এবং প্রশাসনের হাতে। কিন্তু জনমতের চাপ হচ্ছে একটাই আইন যেন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হয় এবং বিচার যেন দৃষ্টান্তমূলক হয়। এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগী কয়েকজন বলেন অতি দ্রুত তার খুব আপনজন বর্তমানে ম্যানেজার শিশির মামুন ও রোকন যদি প্রশাসনের নজরসহ গ্রেফতার হয় তাহলে মনছুর আলম পাপ্পির সব অপরাধই জানা সম্ভব।
প্রতিবেদনের বিষয়টা কানাডায় থাকা মনছুর আলম পাপ্পির হোয়াটসঅ্যাপে জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করেননি
ধারাবাহিক ৩ পর্বের প্রথম পর্ব



