
মুহাম্মদ জুবাইর
চট্টগ্রাম ৪ আসনে মনোনয়ন ঘিরে নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিএনপি শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছে দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য লায়ন মোহাম্মদ আসলাম চৌধুরীকে।প্রাথমিকভাবে ঘোষিত প্রার্থী পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে ইতিমধ্যে এলাকায় নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।আজ শনিবার সকাল ১১টার দিকে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ইউনিয়নের জলিল গেট এলাকায় নিজ বাসভবনে স্থানীয় নেতা কর্মীদের নিয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার চিঠি তুলে ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানান আসলাম চৌধুরী।এ সময় তিনি কর্মী সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন,অতীতের সব বিভেদ ভুলে সবাইকে ধানের শীষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে এবং বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে।
বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান দুপুরে সাংবাদিকদের নিশ্চিত করে বলেন, সীতাকুণ্ড কেন্দ্রের প্রার্থী পরিবর্তন করে আসলাম চৌধুরীকে চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এ মনোনয়ন এখন স্থিতিশীল।এর আগে গত ৩ নভেম্বর এই আসনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের নাম।ঘোষণার পর তিনি ১৮ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেন। সেই ঘোষণার পর থেকেই এলাকায় দুই প্রার্থীর সমর্থকদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান তৈরি হয় যা পরবর্তীতে নানা উত্তাপ ছড়িয়ে দেয় পুরো সীতাকুণ্ড ও আশপাশের এলাকায়।
আজ সকালে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় আসলাম চৌধুরী বলেন, কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন এত দিন ধানের শীষের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছেন এবং তিনি পরীক্ষিত নেতা। দলের স্বার্থে সবাইকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে, কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নন, সবাই একই পতাকার সৈনিক। বিজয়ের লক্ষ্য সামনে রেখে দলীয় শৃঙ্খলার জায়গায় কেউ যেন ঘাটতি না রাখে, এই আহ্বানও জানান তিনি।
অন্যদিকে দলের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।সীতাকুণ্ড উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব কাজী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, বিষয়টি শুনেছি তবে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত নই। দল যাঁকেই চূড়ান্ত মনোনয়ন দিক আমরা সবাই ধানের শীষের পক্ষে কাজ করব এবং মাঠে একসঙ্গে থাকব।
উল্লেখ্য, ৩ নভেম্বর কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের নাম ঘোষণার পরপরই আসলাম চৌধুরীর সমর্থকেরা ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন।কোথাও কোথাও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে তারা প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি তোলে। এমনকি একই দিন ঢাকা চট্টগ্রাম রেলপথেও অবরোধ হয় যার কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে। এসব ঘটনায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কারও করা হয় বলে জানা গেছে। অন্যদিকে প্রার্থী ঘোষণার পর সালাউদ্দিনের অনুসারীরা আনন্দ মিছিল করেন এবং এলাকায় ব্যানার ফেস্টুনে অভিনন্দনের জোয়ার ওঠে। সেই থেকেই দুই পক্ষের সমর্থকেরা পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন যা দলের ভেতরে বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছিল।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি মো. মোরসালিন বলেন, বিএনপি ২০ ডিসেম্বর ৩০০ আসনের মনোনীতদের নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ সভার আয়োজন করে। সেখানে আসলাম চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন এবং ওই দিনই দল তাঁকে মৌখিকভাবে প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করে। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে চিঠিও প্রদান করা হয়। ফলে এখন আর কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা নেই।
দলীয় সূত্র জানায়, মাঠের বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক সমীকরণ বিবেচনা করেই শেষ মুহূর্তে প্রার্থী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।স্থানীয় পর্যায়ের নানা সমীকরণ, কর্মী সমর্থকদের অবস্থান এবং আসন্ন নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা বিবেচনায় এনে আসলাম চৌধুরীর ওপর আস্থা রাখে দল। তবে কেন্দ্রীয় এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে এখন সবার দৃষ্টি দুই শীর্ষ নেতার ভূমিকায় এবং কীভাবে তারা কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনী মাঠে কাজে নামতে পারেন সেটির দিকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রার্থী ঘোষণার পরপরই যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে সীতাকুণ্ড আসনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল নতুন কোনো বিষয় নয়। বহুদিন ধরেই এখানে দুই পক্ষের টানাপোড়েন ছিল এবং সেটিই প্রার্থী ঘোষণার পর প্রকাশ্যে ফেটে পড়ে।এখন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে নতুন করে যে সমীকরণ তৈরি হলো তা কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা নির্ভর করবে স্থানীয় নেতাদের দূরদর্শিতা এবং কর্মীদের নিয়ন্ত্রণের ওপর।
এলাকার সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও এ নিয়ে আলোচনা চলছে। কেউ বলছেন, শেষ মুহূর্তে প্রার্থী বদল দলীয় সংগঠনের শক্তি প্রমাণ করে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। তবে সবাই একমত যে, শেষ পর্যন্ত মাঠের কাজের মধ্য দিয়েই বুঝা যাবে কে কতটা গ্রহণযোগ্য।
বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এখন দলের প্রধান লক্ষ্য ধানের শীষের প্রতীককে ঘিরে শক্ত জনসমর্থন তৈরি করা এবং সব দ্বন্দ্ব ভুলে কর্মীদের ঐক্য নিশ্চিত করা। নির্বাচন সামনে রেখে তারা ঘরে ঘরে প্রচার অভিযান জোরদার করবেন। দলীয় সিনিয়র নেতারাও চট্টগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন যাতে কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝি না থাকে।
রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি এই পরিবর্তন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে মতামত জানাচ্ছেন এবং বিএনপির এই সিদ্ধান্তকে সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, হঠাৎ এমন পরিবর্তন নির্বাচনী প্রস্তুতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম ৪ আসনে এখন নির্বাচনী উত্তেজনা তুঙ্গে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থী পরিবর্তনের পর সবাই এখন তাকিয়ে আছেন মাঠের লড়াইয়ের দিকে। দুটি পক্ষের সমর্থকরা যদি সত্যিই এক হয়ে কাজ করতে পারেন তাহলে বিএনপির জন্য এই আসনটিতে ভালো সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। আর যদি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দমিয়ে রাখা না যায় তাহলে সেই সুযোগ নিতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো।
এখন দেখার বিষয়, আসলাম চৌধুরী কত দ্রুত মাঠে সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন এবং কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেন। একই সঙ্গে কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের ভূমিকা ও অবস্থানও এই সমীকরণে বড় প্রভাব ফেলবে। তিনি যদি সত্যিকারের দলীয় স্বার্থে কাজ করেন তাহলে বিএনপির জন্য এই লড়াই অনেক সহজ হয়ে যেতে পারে।
চট্টগ্রাম ৪ আসনের এই রাজনৈতিক নাটকীয়তা প্রমাণ করে,বড় দলের রাজনীতিতে শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্ত কতটা প্রভাব ফেলতে পারে এবং কর্মীদের আবেগ কত দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারে।এখন অপেক্ষা শুধু নির্বাচনের দিন মাঠের ফলাফলের,যেখানে নির্ধারিত হবে সকল বিতর্কের চূড়ান্ত পরিণতি।



