চট্টগ্রাম

কনকনে শীতে সড়কে ফেলে যাওয়া দুই শিশু আগলে ধরে রেখেছিল চার বছরের আয়শা

মুহাম্মদ জুবাইর

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পিএবি সড়কের বারখাইন ইউনিয়নের শোলকাটা এলাকায় কনকনে শীতের রাতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। রবিবার (২৮ ডিসেম্বর)গভীর রাতে অসুস্থ দুই শিশুকে সড়কের পাশে ফেলে রেখে যায় তাদের স্বজনরা।এ সময় মাত্র চার বছরের ছোট্ট শিশু আয়শা তার অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী ছোট ভাই মোরশেদকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বসেছিল শীতের মধ্যে।পথচারীরা দৃশ্যটি দেখে এগিয়ে এলে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে এবং শুরু হয় শিশুদ্বয়কে নিয়ে আলোচনা।

স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা যায়,শিশুদের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মৌলভীর দোকান এলাকায়। বড় শিশুটির নাম আয়শা (৪) এবং ছোট ভাইয়ের নাম মোরশেদ।শিশুদ্বয় বর্তমানে স্থানীয় হাজিগাঁও ঝিওরি গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা সিএনজি চালক মহিম উদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে।

সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে সাংবাদিকরা আশ্রিত শিশু আয়শার সঙ্গে কথা বলেন। সরল কণ্ঠে আয়শা জানায়,তাদের বাবার নাম খোরশেদ আলম এবং মায়ের নাম ঝিনুক।সে আরও জানায়,তার এক খালা তাদেরকে মা-বাবার কাছ থেকে এনে সড়কের পাশে বসিয়ে রেখে চলে গেছে।কেন রেখে গেছে,সে তা বুঝতে না পারলেও তার কণ্ঠে ছিল ভয়, অসহায়ত্ব আর অনিশ্চয়তার ছাপ।

শিশুদের আশ্রয়দাতা মহিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, রাতে দেখি সড়কের পাশে মানুষ ভিড় করছে।কাছে গিয়ে দেখি দুইটা ছোট শিশু কাঁপছে শীতে।বড় মেয়েটা তার ভাইটাকে বুকে আগলে রেখেছে।তখন আমি কাছে গিয়ে কথা বলি,সব শুনে তাদের নিজের বাসায় নিয়ে আসি। প্রথমেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের খবর দেই,যেন শিশুগুলোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যায়।

তিনি আরও জানান,শিশুদ্বয়কে বাসায় আনার পর দ্রুত তাদের গোসল করানো হয়,গরম জামাকাপড় দেওয়া হয় এবং খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।ধীরে ধীরে তারা কথা বলতে শুরু করে এবং নিজেদের নাম ঠিকানা জানায়।
মহিম উদ্দিনের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন,দুইটা শিশু খুব অসুস্থ ছিল।বিশেষ করে ছোট ছেলেটি প্রতিবন্ধী।আমরা ধারণা করছি অসুস্থতার কারণেই হয়তো মা-বাবা বা স্বজনরা এমন নির্দয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এটা খুব কষ্টের। শিশুগুলোর যেন সঠিক চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, সেটাই আমরা চাই।

এ ঘটনায় দ্রুতই প্রশাসন নড়েচড়ে বসে।বিষয়টি জানার পর আনোয়ারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।তিনি বলেন,শিশু দুটির ছবি ও তথ্য আমরা বিভিন্ন থানায় পাঠিয়েছি।অভিভাবক বা স্বজনদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ আশ্রয়ের বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার জানান,শিশু দুটিকে সড়কের পাশ থেকে উদ্ধার করে সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে সেইভ হোমে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।এজন্য পুলিশ প্রশাসন ও সমাজসেবা কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন,আইন অনুযায়ী এসব শিশুদের দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করবে,যতক্ষণ না তাদের নিরাপদ অভিভাবক বা আইনসম্মত তত্ত্বাবধায়ক পাওয়া যায়।স্থানীয়দের অনেকেই বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। তাদের মতে,অসুস্থ শিশুকে সড়কে ফেলে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।সন্তান জন্ম দেওয়ার চেয়েও বেশি দায়িত্ব হলো সন্তানকে লালন-পালন ও সুরক্ষিত রাখা।কিন্তু এই শিশুদের ক্ষেত্রে তার উল্টোটা ঘটেছে।তারা প্রশ্ন তুলেছেন-অর্থনৈতিক অক্ষমতা থাকলেও কি এটাই ছিল শেষ সমাধান?

এ ঘটনায় ক্ষোভের পাশাপাশি করুণা ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি আলোচনার সৃষ্টি করেছে।অনেকেই এগিয়ে এসে শিশু দুইটির চিকিৎসা ও লালন-পালনের দায়িত্ব নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছেন।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে,এ ধরনের ঘটনা শিশুদের মনে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক আঘাত সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে চার বছরের একটি শিশুর জন্য রাতের অন্ধকারে অপরিচিত স্থানে অসুস্থ ভাইকে নিয়ে বসে থাকা অত্যন্ত ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।তাই শুধু আশ্রয় নয়,তাদের জন্য মানসিক সহায়তাও জরুরি।

এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে সমাজের আরেকটি চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক সংকট,অসচেতনতা এবং দায়িত্বহীনতার শিকার হচ্ছে নিষ্পাপ শিশু প্রাণ।তাদের কোনো অপরাধ নেই,তবুও সবচেয়ে বড় মূল্যটা দিতে হচ্ছে তাদেরই।
বর্তমানে শিশু আয়শা ও তার ভাই নিরাপদে আছে। প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় কোথায় তাদের বাবা–মা?কেন এমন অমানবিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল পরিবার? তারা কি তাদের সন্তানের কাছে ফিরবে?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অপেক্ষায় এখন পুরো এলাকা। কিন্তু তার থেকেও বড় সত্য হচ্ছে মানবিক এই পৃথিবীতে কোনো শিশুর যেন আর কখনো শীতের রাতে সড়কের পাশে ফেলে রাখা ভাগ্যে না জোটে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button