রাজনীতি

বেগম খালেদা জিয়া জন্ম থেকে শেষপ্রহর পর্যন্ত এক নারীর সংগ্রামগাথা

মুহাম্মদ জুবাইর

শৈশব কৈশোর এবং পরিবারের উষ্ণতার ভেতর গড়ে ওঠা এক সাহসী মন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অবিচ্ছেদ্য নাম হলো বেগম খালেদা জিয়া। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর শহরের মুদিপাড়া এলাকায়। তাঁর পিতা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী এবং মা তৈয়বা মজুমদার ছিলেন গৃহিণী।শৈশব থেকেই খালেদা ছিলেন নরম স্বভাবের কিন্তু মনের ভেতরে ছিল অসাধারণ দৃঢ়তা।

পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।দিনাজপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াকালীন থেকেই তিনি ছিলেন ভদ্র মার্জিত এবং আত্মবিশ্বাসী একজন ছাত্রী।তাঁর চারপাশের মানুষ তাঁকে চিনত বিনয়ী পুতুল নামেই।তিনি বড় হতে হতে শিখেছিলেন মানুষের প্রতি ভালোবাসা কাকে বলে।তাঁর বাবা মা তাঁকে শিখিয়েছিলেন সম্মান দিতে এবং মানুষের পাশে থাকতে।কৈশোরেই তৈরি হয়েছিল তাঁর সহনশীলতা এবং আত্মমর্যাদাবোধ।সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তখনও প্রকাশ্যে ছিল না কিন্তু মনের ভেতরই জন্ম নিচ্ছিল এক ভবিষ্যত নেতৃত্বের বীজ।

১৯৬০ সালের দিকে খালেদা পরিচিত হন তরুণ সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে।খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে পরস্পরের প্রতি সম্মান আর ভালোবাসা।তাঁদের বিয়ে হয় পরিবারের উপস্থিতিতে।এই সংসার জীবনে তারা পান দুই সন্তান তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকোকে।খালেদা ছিলেন একজন স্নেহশীল মা।সন্তানদের আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন।আবার স্বামী জিয়াউর রহমানের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ছিল গভীর।

স্বামীর সাফল্যে তিনি গর্বিত ছিলেন এবং তাঁর দায়িত্বপূর্ণ জীবনে ছিলেন শক্তির উৎস।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান দেশকে সংগঠিত ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।খালেদা এ সময় সন্তানদের নিয়ে ছিলেন উদ্বেগে কিন্তু একই সঙ্গে গর্বেও।যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের সময়েও তিনি ছিলেন স্বামীর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।১৯৮১ সালের ৩০ মে এক মর্মান্তিক ঘটনায় চট্টগ্রামে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

এই মৃত্যু বিধ্বস্ত করে খালেদাকে।স্বামীর মৃত্যু ছিল যেন তাঁর জীবনের সবকিছু কেড়ে নেওয়া।কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি।বরং বুকের ভেতরের ব্যথাকে শক্তিতে রূপান্তর করে দেশের মানুষের জন্য নতুন করে নিজেকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন।স্বামীর মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টিতে এবং অল্প সময়েই হয়ে ওঠেন দলের প্রধান।১৯৮৪ সাল থেকে তিনি দলের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলন সংগ্রাম এবং ত্যাগ তাঁকে মানুষের কাছে করে তোলে দৃঢ়চেতা নেত্রী।তিনি কখনো আপস করেননি অন্যায়ের সঙ্গে।তাঁর ভাষণ তাঁর উপস্থিতি মানুষের হৃদয়ে সাহস জাগাত।দেশের প্রত্যেকটা মানুষকে তিনি দেখতেন নিজের আপনজনের মতো।তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশের মানুষই তাঁর আসল শক্তি।১৯৯১ সালে তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী দেশের প্রধানমন্ত্রী হন।পরবর্তীতে ২০০১ সালেও তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তাঁর সময়কালে অবকাঠামো উন্নয়ন নারীশিক্ষা সম্প্রসারণ দারিদ্র্য হ্রাস কর্মসূচি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।ক্ষমতার মধ্যেও তিনি ছিলেন সহজ সরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।সাধারণ মানুষের কষ্ট তাঁকে কাঁদাত।বন্যা ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগের সময় তিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতেন মায়ের মতো স্নেহ নিয়ে।রাজনীতির পথ কখনোই সহজ ছিল না তাঁর জন্য।বারবার তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছে।মোট কয়েক বছর তাঁকে বন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়েছে।তবুও তিনি নতি স্বীকার করেননি।

গণতন্ত্রের বিশ্বাস এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে সবসময় অটল রেখেছে।এই সময়ে তাঁর স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটে।কিডনি হৃদরোগ আর্থ্রাইটিসসহ নানা জটিল রোগে তিনি দীর্ঘদিন কষ্ট ভোগ করেন।কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত শক্তভাবে সবকিছুর মোকাবিলা করেছেন।খালেদা জিয়া শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না।তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কোটি মানুষের ভালোবাসার একটি নাম।নেতাকর্মীদের তিনি দেখতেন নিজের সন্তানের মতো।তাদের দুঃখ কষ্টে তিনি পাশে থাকতেন।

তাঁর মন ছিল কোমল কিন্তু সিদ্ধান্ত ছিল দৃঢ়।তিনি বলতেন মানুষ আমাকে ভালোবাসে বলেই আমি বেঁচে আছি।এই ভালোবাসাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।দীর্ঘ অসুস্থতা শেষে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালে এবং মৃত্যু হয় ২০২৫ সালে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।জীবনের শেষ সময় তিনি ছিলেন চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরিবারের স্নেহময় পরিবেষ্টনে।তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সারা বাংলাদেশে।

মানুষ কাঁদে একজন মা নেত্রীর বিদায়ে।বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দৃঢ়চেতা নারী।তিনি ছিলেন স্ত্রী হিসেবে অনন্য প্রেমময়ী মা হিসেবে অসীম স্নেহময়ী আর রাজনীতিবিদ হিসেবে অদম্য সংগ্রামী।তিনি ইতিহাসে বেঁচে থাকবেন মানুষের ভালোবাসায় শ্রদ্ধায় আর স্মৃতিতে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button