অপরাধআইন ও বিচারজাতীয়দুর্নীতিপ্রশাসনবাংলাদেশসিলেট

সিলেট গ্যাস ফিল্ডে নিয়োগ দুর্নীতি: প্রদীপ শর্মার বিরুদ্ধে অভিযোগ

৩ লাখ টাকায় ড্রাইভার নিয়োগ; অতীতেও কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট: সিলেট গ্যাস ফিল্ডে আবারও অর্থের বিনিময়ে শ্রমিক নিয়োগের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এবার রশিদপুর ফিল্ডে একজন ড্রাইভার নিয়োগকে কেন্দ্র করে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের অভিযোগের তীর উঠেছে কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি প্রদীপ কুমার শর্মা ও যুগ্ম সম্পাদক নজরুল ইসলামের দিকে। এই ঘটনা সিলেট গ্যাস ফিল্ডের নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং সিবিএ’র ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তৈরি করেছে।

সর্বশেষ নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সিলেট গ্যাস ফিল্ডের অধীনস্থ রশিদপুর ফিল্ডে নৈমিত্তিক হাজিরা ভিত্তিতে সিরাজুল ইসলাম নামে একজন ড্রাইভারকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগের খবর ছড়িয়ে পড়তেই অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, এই নিয়োগের বিনিময়ে সিবিএ সভাপতি প্রদীপ কুমার শর্মা ও যুগ্ম সম্পাদক নজরুল ইসলাম তিন লক্ষ টাকা গ্রহণ করেছেন।

প্রদীপের বিরুদ্ধে পুরোনো অভিযোগ ও রাজনৈতিক প্রভাব
এটি প্রদীপ কুমার শর্মার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ নয়। এর পূর্বে ২০২০ সালে সিবিএ থাকাকালীন সময়ে গ্যাস ফিল্ডের প্রধান কার্যালয়ে ৫২ জন শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে তিনি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তৎকালীন সময়ে এই সংবাদ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায়। এছাড়া, গত ১৮ মে জাতীয় দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত ‘প্রদীপের ‘ম্যাজিক’ শিরোনামের একটি খবরে তার অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা উঠে আসে।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রদীপ কুমার শর্মার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগও উঠেছে। গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে প্রদীপ কুমার শর্মা আওয়ামী লীগের লেবাস বদলে আবারও বিএনপি সমর্থিত হন বলে অভিযোগ। তিনি জৈন্তাপুরের স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের সমন্বয় করে গঠিত বিএনপি সমর্থিত কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে বর্তমান সিবিএ’র নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি কর্মচারী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সোবানকে শোকজ করিয়েছেন এবং আব্দুল খালিক, মুতালেব, নাজমুল ইসলাম, মঞ্জুর হোসেন সহ প্রায় ২৫ জন অন্যান্য নেতা ও সমর্থককে সিলেট গ্যাস ফিল্ড প্রধান কার্যালয় থেকে বিভিন্ন ফিল্ডে বদলি করেছেন। এমনকি, প্রদীপ কুমারের নেতৃত্বে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত নেতারা জৈন্তাপুরের চিকনাগুল পানিছড়ার গ্যাস ফিল্ডটির প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত সিবিএ অফিসে তালা লাগিয়ে দেন।

সিবিএ-র স্বীকৃতি ও বেপরোয়া কার্যক্রম
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কর্মচারী লীগের সিবিএ’র মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় এবং তাদের কোনো কার্যক্রম না থাকায়, গত ৫ মে সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, শ্রম অধিদপ্তর, আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর এবং কর্মচারী লীগ (রেজিঃনং ১৮৮৯)-কে কোনো প্রকার অবগত বা চিঠি প্রদান না করে, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড-এর কর্মচারী ইউনিয়ন (রেজিঃ নং বি-১১০৬)-কে যৌথ দরকষাকষি প্রতিনিধি (সিবিএ) ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই প্রদীপ কুমার শর্মার নেতৃত্বাধীন এই সিবিএ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং তাদের নেতৃত্বে গ্যাস ফিল্ডে অনিয়ম-দুর্নীতি ও বিভিন্ন টেন্ডার নিয়ে ঘুষ বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ।

শ্রমিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
বর্তমানে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের প্রধান কার্যালয়ে ৫২ জনসহ অন্যান্য বিভিন্ন ফিল্ডে মোট ২৮০ জন নৈমিত্তিক হাজিরা ভিত্তিতে কর্মরত শ্রমিক রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে এই শ্রমিকরা তাঁদের চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন। তাঁরা জানান, গ্যাস ফিল্ড প্রশাসনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও তাঁরা বিষয়টি অবগত করেছেন এবং আশ্বস্ত হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের চাকরি স্থায়ীকরণ বা আইডি ও প্রত্যয়ন প্রদান করা হয়নি। শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এবং বর্তমান সিবিএ নেতৃত্ব শুধু আশার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই সিবিএ আবারও নতুন শ্রমিক নিয়োগের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিবিএ সভাপতি প্রদীপ কুমার শর্মা জানান, “এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। গ্যাস ফিল্ড কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে বলতে পারবেন।”

রশিদপুর ফিল্ডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী সুমন বিকাশ দাস জানান, “আমার দপ্তরে একজন ড্রাইভার প্রয়োজন মর্মে প্রধান কার্যালয়ে চিঠি প্রেরণ করেছিলাম। তার প্রেক্ষিতে নৈমিত্তিক হাজিরা ভিত্তিতে সিরাজুল ইসলাম নামে একজন ড্রাইভারকে আমার দপ্তরে প্রেরণ করা হয়। সে কীভাবে নিয়োগ পেল, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।”

শ্রমিক নিয়োগ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আলাউদ্দিন এন্টারপ্রাইজ-এর স্বত্বাধিকারী আলাউদ্দিন বলেন, “গ্যাস ফিল্ড সার্ভিস দপ্তর থেকে যে তালিকা পাঠানো হয়, সে অনুযায়ী আমি টাকা প্রদান করে থাকি। এর বাইরে আমার কিছু জানা নেই।”

নিয়োগপ্রাপ্ত ড্রাইভার সিরাজুল ইসলাম টাকার বিনিময়ে চাকরি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, “টাকা ছাড়া এই দেশে কিছু হয় না, কিছু না কিছু দিয়েই তো এই অবস্থানে এসেছি।”

জিএম ফরিদুল হুদা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, “এ বিষয়ে আমার জানা নেই।”

কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আব্দুল জলিল প্রামাণিক জানান, “অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।” এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছে শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট মহল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button