Uncategorizedবাংলাদেশ

মদিনা সনদ, ম্যাগনা কার্টা ও জুলাই সনদ: রাষ্ট্রব্যবস্থার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা

অধ্যাপক এম এ বার্ণিক

১. ভূমিকা

মানব সভ্যতার বিকাশে রাষ্ট্রব্যবস্থা কখনও স্থির থাকেনি, বরং সময়ের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে। ইতিহাসের নানা বাঁকে কিছু দলিল, সনদ বা চুক্তি রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা করেছে। মদিনা সনদ (৬২২ খ্রি.), ম্যাগনা কার্টা (১২১৫ খ্রি.) এবং জুলাই সনদ (২০২৪ খ্রি.)—এই তিনটি ঘটনাকেই রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশে যুগান্তকারী ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এগুলোকে এক সূত্রে গাঁথলে বোঝা যায়, ন্যায়বিচার, জবাবদিহি ও জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণা মানব ইতিহাসে বারবার নবায়িত হয়েছে।

২. মদিনা সনদ: বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ভিত্তি

৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর বিভিন্ন গোত্র ও ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিয়ে যে চুক্তিপত্র প্রণয়ন করেন, ইতিহাসে তা “মদিনা সনদ” নামে পরিচিত।

  • এই সনদের মাধ্যমে মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য গোত্রকে নিয়ে একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলা হয়।
  • প্রত্যেক সম্প্রদায়কে নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
  • রাষ্ট্রীয় আইন ও শান্তি রক্ষার জন্য সবাইকে সমানভাবে দায়িত্বশীল করা হয়।
  • রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহানবী (সা.) সর্বোচ্চ বিচারক ও শাসক হিসেবে জনগণের সম্মতিতে স্বীকৃতি লাভ করেন।

অনেক ইতিহাসবিদ এটিকে বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যেখানে ন্যায়বিচার, সহাবস্থান ও মানবাধিকার রক্ষার মূলনীতিগুলো সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।

৩. ম্যাগনা কার্টা: রাজতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা ও গণতন্ত্রের বীজ

১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জনকে তাঁর দেশের অভিজাত শ্রেণি একটি দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে, যা ইতিহাসে “ম্যাগনা কার্টা” বা মহাসনদ নামে পরিচিত।

  • এই সনদ প্রথমবারের মতো রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতাকে সীমিত করে এবং स्थापित করে যে, রাজাও আইনের ঊর্ধ্বে নন।
  • কর আরোপ এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের প্রতিনিধিদের (পরবর্তীকালে সংসদ) অনুমোদনের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
  • আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া কোনো স্বাধীন মানুষকে শাস্তি দেওয়া যাবে না—এই নীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়।

ম্যাগনা কার্টাকে আধুনিক সাংবিধানিক শাসন, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের (Rule of Law) ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি প্রমাণ করে যে, জনগণের সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বৈধ হতে পারে না।

৪. জুলাই সনদ: জনগণের রক্তে রচিত অঙ্গীকার

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে একটি অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। শত শত প্রাণের আত্মদান, ছাত্র-যুবকদের নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এক নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে।

  • স্বৈরাচার, পরিবারতন্ত্র ও বৈষম্যের অবসান ঘটানোই ছিল এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।
  • শহীদদের রক্তের বিনিময়ে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির এক নতুন অঙ্গীকার সৃষ্টি হয়।
  • আন্দোলনের তীব্রতায় রাজনৈতিক দলগুলোও জনগণের ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়, যা বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক নতুন ভিত্তি স্থাপন করে।

যদিও এটি এখনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দলিলের রূপ পায়নি, তবুও জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমে অলিখিতভাবে যে “জুলাই সনদ” গড়ে উঠেছে, তা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৫. ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা

  • মদিনা সনদ: বহুত্ববাদ ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রথম লিখিত রূপ।
  • ম্যাগনা কার্টা: রাজশক্তিকে সীমিত করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বীজ বপন।
  • জুলাই সনদ: আধুনিক বাংলাদেশে জনগণের রক্তে রচিত মুক্তি, ন্যায়বিচার ও সার্বভৌমত্বের অঙ্গীকার।

এই সনদগুলো একে অপরের ধারাবাহিকতায় মানব ইতিহাসকে এই শিক্ষাই দেয় যে, জনগণই রাষ্ট্রশক্তির মূল উৎস এবং ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো শাসনব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।

৬. উপসংহার

মদিনা সনদ, ম্যাগনা কার্টা ও জুলাই সনদ—এই তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ও ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে ঘটলেও এদের মূল চেতনা এক ও অভিন্ন। প্রতিটি দলিলই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শাসকের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে আনার অনন্য নিদর্শন। তাই বলা যায়, রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্রমবিকাশে এগুলো শুধু ঐতিহাসিক দলিল নয়, বরং মানবমুক্তির ধারাবাহিক অঙ্গীকার। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘জুলাই সনদ’কে একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি তুলনা করা সমীচীন হবে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button