এম. এইচ. খান: বিশ্বের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ব্যাংক কেলেঙ্কারির খল নায়ক এস. আলম গ্রুপ । পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন রেহানার ছিদ্দিকীর আশ্রয় – প্রশ্রয়ে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফজলে কবির ও ডি-গ্রেড গভর্নর আঃ রউফ তালুকদারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি শক্তিশালী চক্রের সহায়তায় এস. আলম গ্রুপ বিশ্বের সর্বাধুনিক কৌশলে প্রয়োগ করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও পাচার করে দেশের ব্যাংকিং খাতকে বিশেষ করে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে অস্তিত্ব ও আস্থার সংকটে ফেলে দিয়েছে। ২০১৭ সালের পর থেকে ব্যাংকগুলোর কোর ইনভেস্টম্যান্ট সংকুচিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে এস. আলমের দখলে থারা ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো তার প্রতিষ্ঠান সমূহের বাহিরে বিনিয়োগ বন্ধ করে দেয়। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ব্যাংকগুলোকে অস্তিত্ব সংকটাপন্ন করে তোলে।
বাংলাদেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং এর পথিকৃত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আর্থিক খাতে বেসরকারি পর্যায়ে সবচেয়ে বড় অর্জন এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি । হাসিনার নাস্তক্য পরিষদের বহুমূখী পরিকল্পনার অংশ ছিলো যে কোনভাবে হোক ইসলামী ব্যাংক দখল করন এবং এটিকে ধ্বংস করন। দীর্ঘ মেয়াদী এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসে এস. আলমের হাতে তুলে দিয়ে। ২০১৬ সালের শেষের দিকে এ দখল প্রক্রিয়ার সব ছক করে দেন ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যাবস্হাপনা পরিচালক ও সিইও আঃ মান্নান এমন অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকটির সাবেক ও বর্তমান অনেক কর্মকর্তার । এর পুরস্কার হিসেবে মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানের বেতন বৃদ্ধিসহ চাকুরী নবায়ন করা হয় (যদিও পরে তিনি তার পদে থাকতে পারেন নি) এমন কথাও বলেছেন কেউ কেউ । ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি দখলে নেয়ার পর চিটাগাং ভিত্তিক এই গ্রুপটির একের পর এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলে নেয়ার পথ সহজ হয়। বহু প্রতিষ্ঠান তারা নামে বেনামে দখলও করে।
২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ছিলো ব্যাংকিং এর সকল সূচকে একটি মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যাংক। যে কোন ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের একজন ক্লাইয়েন্টকে মূল্যায়ন করতেন সম্মানের সাথে। এস. আলমের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর ক্রমান্বয়ে ব্যাংকটি আর্থিক সূচক সমূহের পতন হতে থাকে। চলতে থাকে লুটপাটের মহোৎসব। ব্যাংকের দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্ত কিছু কিছু কর্মকর্তা পদ পদবী ও প্রমোশনের লোভে এস. আলমের নিয়োগ দেয়া দালালদের হাতে হাত মিলিয়ে লুটপাটের পথ সুগম করে দিয়ে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও গুন্জন রয়েছে। এ ছাড়া আব্দুল হামিদ মিয়া এমডি দায়ীত্ব পালনকালীন সময়ে বর্তমানে ইভিপি পদ মর্যাদার এক কর্মকর্তা ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনে আ. লীগ প্যানেলে ভোট চেয়ে সকলের কাছে হাত তুলিয়ে সমর্থন আদায় করেন।
তৎকালীন এমডি আব্দুল হামিদ মিয়াও বিষয়টি তখন ভালো চোখে দেখেন নি। এমন ঘটনাও ঘটেছে শরীয়া ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানে। আব্দুল হামিদ মিয়া এক জায়গায় মন্তব্য করে বলেছিলেন, মানুষ এভাবে রূপ পরিবর্তন করে কীভাবে? এরাতো আদর্শিক মানুষ। এখন তারা অবলীলায় জামাআতের একনিষ্ঠ লোক পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ব্যাংকটিতে নিয়োগেও পালন করা হয় নি কোন রকম নিয়মনীতি। পালন করা হয় নি কোন সার্ভিস রূলস। এটি একটি শরিয়া ভিত্তিক ব্যাংক হলেও শরীয়া এখান থেকে সরে দাড়ায়। এস. আলমের নিয়োগ প্রাপ্ত দালাল চক্রের চাওয়াই ছিলো আইন – কানুন, বিধি । সর্বস্তরের কর্মকর্তা – কর্মচারী ছিলো তাদের হাতে জিম্মি। এই জিম্মি দশা থেকে মুক্তির কোন পথও কারো জানা ছিলো না।
শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই ক্ষান্ত হননি, এই ব্যাংকের টাকা নিজের দখলদারিত্বে থাকা অন্য ব্যাংকে আমানত হিসেবে স্হানান্তরিত করে তা লুটে নিয়েছেন। এতে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় আট হাজার কোটি টাকা আটকে গেছে এস. আলমের দখলে থাকা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে।
এস আলমের বেপরোয়া অর্থ তুলে নেওয়া শুরু হয় ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তনের পরপরই। এ কারণে মালিকানা পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান আরাস্তু খান পদত্যাগ করেন।
২০১৭ সালে আওয়ামী সরকার রাস্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহার করে ব্যাংকটির মালিকানা এস আলম গ্রুপের কাছে তুলে দেয়। এরপর ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় অর্ধেক নামে-বেনামে নিয়ে নেয় গ্রুপটি। সেই সঙ্গে এস আলমের নিজ এলাকা চট্টগ্রামের পটিয়ার প্রায় ১০ হাজার লোককে ব্যাংকটিতে নিয়োগ দেয়। এ সকল কর্মকর্তাদের বিপুল সংখ্যক সনদ জাল জালিয়াতি করে ব্যাংকে যোগদান করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও নৈতিকতা দোষে দুষ্ট এমন সংখ্যাও কম নয় বলে জানা গেছে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে।
কয়েকটি ব্রান্চে খবর নিয়ে জানা গেছে, এস. আলম কতৃক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারাদের কারনে ব্যাংকটির সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। প্রায় ব্রান্চে অর্ধেক সংখ্যক এস. আলমের নিয়োগ দেয়া লোক। সব জায়গায় ক্যাশ অফিসার চট্রগ্রামের পটিয়ার লোকজন। এরা কাজে বেশ অদক্ষ। আগে দুইজন অফিসারের পক্ষে যে সেবা প্রদান সম্ভব ছিলো এখন তা ছয়জনেও দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের সুনাম – সুখ্যাতি নষ্ট হচ্ছে। এসব অযোগ্য অদক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে ব্যাংকের ঘাড়ে একটি বড় বোঝা হিসেবে মনে করছেন অনেকে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকটিকে এস আলম গ্রুপমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন কর্মকর্তারা। এরপর গত ২২ আগস্ট ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে তা পুনর্গঠন করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকটির প্রায় আট হাজার ৪২৫ কোটি টাকা জমা আছে। এর মধ্যে কোনো ব্যাংকে মেয়াদি আমানত হিসেবে, আবার কোনোটিতে ধার হিসেবে টাকা দেয়া হয়েছে। এসব টাকার কিছু অংশ ইসলামী ব্যাংক ফেরত পেলেও বড় অংশই আটকা পড়েছে, যার পরিমাণ ৮ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা।
গত সোমবারের হিসাব অনুযায়ী সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ইসলামী ব্যাংকে ১ হাজার ১৭ কোটি টাকা আটকা পড়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৩ হাজার ৪৩ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকে ২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৫৪৭ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান আভিভা ফাইন্যান্সে আটকা পড়েছে ৬৯০ কোটি টাকা। মেয়াদ শেষ হলেও এসব টাকা ফেরত পাচ্ছে না ইসলামী ব্যাংক। অনেক সময় মুনাফার টাকাও পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেও ইতিমধ্যে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ও আভিভা ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান ছিলেন স্বয়ং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও আভিভা ফাইন্যান্স আগে প্রচলিত ধারার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছিল। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার। তিনি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লে ২০২১ সালে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাম বদলে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের নাম পরিবর্তন করে আভিভা ফাইন্যান্স রাখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন বিশেষ বিবেচনায় ব্যাংক দুটিকে ইসলামী বানিয়ে দেয়। দুই নথিতেই সই করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তখনকার গভর্নর ফজলে কবির। এরপর ইসলামী ব্যাংক থেকে এই দুটি প্রতিষ্ঠানে টাকা নেওয়ার দ্বার খুলে যায়। এভাবে আটকে পড়েছে ইসলামী ব্যাংকের টাকা। এদিকে ব্যাংকটির অর্ধেকের বেশি টাকা এস আলম গ্রুপ একাই নিয়ে গেছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন নতুন চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ, যা পরিমাণে ৮৮ হাজার কোটি টাকা।
অপর একটি সূত্র জানায়, এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর শুরুতে সরাসরি ঋণ নেয়নি; বরং গ্রুপটির মালিকানায় থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা জমা রাখে ইসলামী ব্যাংক। সেই আমানতের মেয়াদ ছিল তিন মাস। তবে বছর পার হলেও সেই টাকা ফেরত পায়নি ইসলামী ব্যাংক। এ কারণে ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আরাস্তু খানের সঙ্গে সাইফুল আলমের ‘কথা-কাটাকাটি’ হয়। এর পরই ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল পদত্যাগ করেন আরাস্তু খান।
আরাস্তু খান সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘উচ্চপর্যায়ের ইচ্ছায় ব্যাংকটির দায়িত্ব নিলেও আমানতের টাকায় অনিয়ম করতে আমি রাজি ছিলাম না। গ্রুপটি অন্য ব্যাংকে টাকা নিয়ে গেলেও তা ফেরত দেয়নি। এ জন্য আমি ব্যাংকটির দায়িত্ব ছেড়ে দিই।’