অপরাধদুর্নীতিবাংলাদেশ

পতেঙ্গায় রেশন কার্ডের ফাঁদ: শত কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা প্রতারক চক্র

মোহাম্মদ জুবায়ের

চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় ইকবাল হাসান নামের এক ব্যক্তির অভিনব প্রতারণায় হাজারো শ্রমজীবী মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বহু গার্মেন্টস নারী শ্রমিকের সংসার ভেঙেছে এবং নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ তাদের শেষ সম্বল হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

সূত্রমতে, পতেঙ্গা এলাকায় ইকবাল হাসান ও তার সহযোগীরা রেশন কার্ড দেওয়ার নামে এই প্রতারণা চালিয়ে আসছিলেন। গত কয়েক বছরে এই চক্রটি সহজ-সরল শ্রমজীবী মানুষকে টার্গেট করে চাল-তেলের রেশন কার্ড দেওয়ার কথা বলে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই প্রতারণায় ইকবাল হাসানের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন গুলতাজ বেগম, নুরুল আবছার এবং গুলতাজ বেগমের স্বামী মান্নান (অপর ভুক্তভোগীর বর্ণনায় হারুন)। এই প্রতারণার মাধ্যমে ইকবাল হাসানের পাশাপাশি গুলতাজ বেগম ও নুরুল আবছারও কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন। তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে অনেক পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে।

প্রতারক চক্রের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস, লোভ এবং তাদের কাছ থেকে যথাযথ আইনি নথি না নেওয়ায় ভুক্তভোগীরা আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। আবার অনেকে টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় নীরব ভূমিকা পালন করছেন। বর্তমানে মূল প্রতারক ইকবাল হাসান আত্মগোপনে থাকলেও তার সহযোগী গুলতাজ বেগম ও নুরুল আবছার জনসম্মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোনো কোনো ভুক্তভোগী গুলতাজ বেগমের কাছে পাওনা টাকা চাইতে গেলে হামলা ও মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানায়, ইকবাল হাসান, গুলতাজ বেগম, নুরুল আবছারসহ তার সহযোগীরা চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা ও ইপিজেড থানার শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস—এমন এলাকাগুলোকে টার্গেট করে। তারা স্বল্পমূল্যে রেশন সামগ্রী ও উচ্চ লাভের লোভ দেখিয়ে প্রচারণা চালায়। চক্রের প্রধান ইকবাল হাসান এলাকার কিছু আস্থাভাজন নারী-পুরুষকে নিয়ে একটি দল তৈরি করেন, যারা সাধারণ মানুষকে রেশন কার্ডে বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করত। অনেকে সমিতি, এনজিও থেকে ঋণ করে বা চড়া সুদে টাকা ধার করে লক্ষ লক্ষ টাকা এই প্রতারক চক্রের হাতে তুলে দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পতেঙ্গা ও ইপিজেড এলাকার পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ এই চক্রের হাতে প্রায় শত কোটি টাকা তুলে দিয়েছেন। অনেকে শুধু নিজের নামে নয়, পরিবারের শিশু সদস্যসহ সবার নামে বিনিয়োগ করেছেন।

প্রতারক ইকবাল হাসান বিশ্বাস অর্জনের জন্য নিজের স্বাক্ষর করা স্ট্যাম্প ও বিভিন্ন ব্যাংকের ফাঁকা চেক (গ্রহীতার নাম ও তারিখ ছাড়া) ভুক্তভোগীদের দিয়েছেন। স্ট্যাম্পগুলোর অধিকাংশে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন গুলতাজ ও নুরুল আবছার। শুরুর দিকে আস্থা অর্জনের জন্য প্রথম এক-দুই মাস কয়েকজনকে রেশন দেওয়া হলেও পরবর্তীতে নানা অজুহাতে কালক্ষেপণ করতে থাকে চক্রটি। একপর্যায়ে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে ইকবাল হাসান আত্মগোপনে চলে যান এবং গুলতাজ বেগম পতেঙ্গা ছেড়ে আনোয়ারায় বসতি গড়েন।

প্রতারণার শিকার শাহাবুদ্দিন জানান, তিনি নুরুল আবছারের কথায় বিশ্বাস করে নিজের ও আত্মীয়-স্বজনের প্রায় ২০ লক্ষ টাকা তুলে দেন। এখন পাওনাদারদের চাপে তিনি দিশেহারা। টাকা ফেরত চাইতে গেলে নুরুল আবছার তাকে হুমকি দিচ্ছেন।

আরেক ভুক্তভোগী গার্মেন্টসকর্মী শিরিন জানান, তিনি নিজে এবং সহকর্মীদেরসহ প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা গুলতাজ বেগমের স্বামীর হাতে তুলে দেন। এই প্রতারণায় শেষ সম্বল হারিয়ে তার সংসার ভেঙে গেছে, স্বামী তাকে তালাক দিয়েছেন।

দিনমজুর নাসির উদ্দিন জানান, তিনি প্রায় ৩০০ জনের কাছ থেকে কোটি টাকা সংগ্রহ করে গুলতাজ বেগমের মাধ্যমে চক্রের হাতে তুলে দেন। এখন পাওনাদারদের চাপে তিনি নুয়ে পড়েছেন।

এদিকে, অভিযুক্ত নুরুল আবছার ও গুলতাজ বেগম মুঠোফোনে অভিযোগ অস্বীকার করে সব দোষ ইকবাল হাসানের ওপর চাপিয়েছেন এবং নিজেদেরও প্রতারিত বলে দাবি করেছেন। গুলতাজ বেগমের স্বামী হারুন প্রতিবেদকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাকে হুমকি দেন। মূল অভিযুক্ত ইকবাল হাসানের সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button