Uncategorizedঅপরাধএক্সক্লুসিভদুর্নীতিসিলেট

ভোলাগঞ্জের ‘সাদা সোনা’ লুট: যেভাবে বাহার-রজন সিন্ডিকেট গড়ে তোলে অপরাধের সাম্রাজ্য

যুবদল নেতাদের নেতৃত্বে এক বছরে হাজার কোটি টাকার পাথর লুট, পুলিশের নামে চলত দৈনিক ২৫ লাখ টাকার চাঁদাবাজি। প্রশাসন ও বিজিবিকে ম্যানেজ করেই চলত এই মহাযজ্ঞ।

ডেস্ক রিপোর্ট:

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি যেন পরিণত হয়েছিল এক অপরাধের অভয়ারণ্যে। বাহার আহমদ রুহেল ও রজন মিয়া নামে দুই যুবদল নেতার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট গত এক বছর ধরে এখানে চালিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার পাথর লুট ও চাঁদাবাজির মহাযজ্ঞ। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এবং এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে তারা এই অপরাধ জগৎ পরিচালনা করছিল।

বাহার-রজন সিন্ডিকেটের উত্থান
সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহার আহমদ রুহেল ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রজন মিয়া ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে ভোলাগঞ্জ কোয়ারির একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠে। পুরনো ক্রিমিনাল রেকর্ডধারী বাহার অতীতে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারা প্রশাসনকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসে এবং কোয়ারিতে নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

যেভাবে লুট হয় ‘সাদা সোনা’
ভোলাগঞ্জ কোয়ারির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ‘সাদাপাথর’ ছিল এই সিন্ডিকেটের প্রধান লক্ষ্য। দীর্ঘদিন বিজিবির কড়া পাহারায় সুরক্ষিত থাকলেও বাহার-রজন সিন্ডিকেট প্রথমে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে। এরপর শ্রমিকদের ব্যবহার করে বিজিবির ওপর একাধিকবার হামলা চালিয়ে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে বিজিবিকে কোণঠাসা করে ফেলে।

এরপরই শুরু হয় সাদাপাথর লুটের মহাযজ্ঞ। স্থানীয়দের মতে, দিনরাত শত শত নৌকা ব্যবহার করে এই লুটপাট চলত। ব্যবসায়ীদের ধারণা, মাত্র দুই সপ্তাহে এই এলাকা থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে।

চাঁদাবাজির ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান
পাথর লুটের পাশাপাশি এই সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল এক বিশাল চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক। শ্রমিকদের অভিযোগ অনুযায়ী, তাদের চাঁদাবাজির চিত্র ছিল নিম্নরূপ:

  • বারকি নৌকা (প্রতিদিন ৫,০০০টি): ৩০০-৫০০ টাকা হারে দৈনিক প্রায় ২০ লাখ টাকা।
  • ফেলুডার (৪০-৫০টি): ৩,০০০ টাকা হারে দৈনিক প্রায় ১.৫ লাখ টাকা।
  • লিস্টার (৫০-৬০টি): ১৫,০০০ টাকা হারে দৈনিক প্রায় ৮ লাখ টাকা।
  • ট্রাক্টর (৪০০-৫০০টি): ২,০০০ টাকা হারে দৈনিক প্রায় ৯ লাখ টাকা।

সব মিলিয়ে, প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা এবং বছরে শতকোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় করত এই চক্র। এই টাকার সামান্য অংশ পুলিশকে দিয়ে বাকিটা সিন্ডিকেটের নেতারা ভাগ করে নিত।

প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতা ও সিন্ডিকেটের সদস্যরা
বাহার-রজন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে একাধিক অভিযোগ জমা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের সিন্ডিকেটে যুবলীগ নেতাসহ শতাধিক সদস্য ছিল, যারা এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে রাখত। সিন্ডিকেটের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে:

  • আলীম উদ্দিন (সভাপতি, পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়ন যুবলীগ)
  • বিলাল আহমদ (যুবলীগ নেতা)
  • বাহারের ভাই গিয়াস উদ্দিন ও নাজিম উদ্দিন
  • আজিদ আহমদ (ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি)
  • শাহাব উদ্দিন, মনির আহমদ, ও আমির উদ্দিন।

বর্তমান পরিস্থিতি
সাদাপাথর লুটের ঘটনা দেশব্যাপী আলোচিত হলে প্রশাসন তৎপর হয়। বর্তমানে মূল হোতা বাহার, রজনসহ সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্য এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান জানিয়েছেন, পাথর লুটের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং ৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে পুলিশের নামে ‘লাইনম্যান’ থাকার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেছেন। এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং লুটেরাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button