ইসলাম ধর্ম

নবীজি (সা.)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ: এশার পর দ্রুত ঘুমানো

ইসলামিক ডেস্ক

প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এশার নামাজের পর দ্রুত ঘুমিয়ে যেতেন। এটি তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ ও জীবনাচরণের অংশ ছিল। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে এবং এটি আমাদের জন্যও একটি উত্তম অভ্যাস।

হাদিসের আলোকে প্রিয় নবীর (সা.) ঘুম:
এশার নামাজের পর অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা না বলে দ্রুত ঘুমানোর ব্যাপারে একাধিক হাদিস বর্ণিত আছে। হযরত আবু বারযাহ আল-আসলামী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে,

“রাসূলুল্লাহ (সা.) এশার নামাজের পূর্বে ঘুমানো এবং এশার নামাজের পর কথা বলা অপছন্দ করতেন।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, রাসূল (সা.) এশার পর গল্প-গুজব বা অপ্রয়োজনীয় কাজকর্মে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমানোকে উৎসাহিত করতেন। এর মূল কারণ ছিল রাতের বাকি অংশকে ইবাদতের জন্য ব্যবহার করা।

এর পেছনের প্রজ্ঞা ও কল্যাণ:
প্রিয় নবী (সা.) কেন দ্রুত ঘুমিয়ে যেতেন, তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ নিচে দেওয়া হলো:

  • ফজরের নামাজের জন্য প্রস্তুতি: তাড়াতাড়ি ঘুমালে রাতের প্রথম ভাগে শরীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায়। এর ফলে ফজরের নামাজের জন্য সতেজ হয়ে ওঠা সহজ হয়। যারা দেরি করে ঘুমায়, তাদের জন্য ফজরের সময় ঘুম থেকে ওঠা কঠিন হয়ে যায়।
  • তাহাজ্জুদের সুযোগ লাভ: রাসূল (সা.) রাতের প্রথম ভাগে ঘুমিয়ে রাতের শেষ ভাগে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। রাতের শেষ ভাগ আল্লাহর ইবাদতের জন্য অত্যন্ত বরকতময়। যারা তাড়াতাড়ি ঘুমায়, তারাই রাতের শেষ ভাগে এই ইবাদতের সুযোগ পায়।
  • শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা: দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়া শরীরকে তার প্রয়োজনীয় বিশ্রাম দেয়। এতে হজম প্রক্রিয়া সুষ্ঠু থাকে, মানসিক চাপ কমে এবং দিনের কাজের জন্য নতুন শক্তি সঞ্চয় হয়। এই অভ্যাস শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত উপকারী।

সুতরাং, প্রিয় নবী (সা.)-এর এই অভ্যাসটি আমাদের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এটি কেবল একটি সুন্নাহই নয়, বরং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই অভ্যাস অনুসরণ করলে আমাদের ইবাদত এবং কর্মজীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা সহজ হয়।

গুরুত্বপূর্ণ হাদিসসমূহ (আরবি ও বাংলা অর্থসহ):

হাদিস ১: এশার পর কথা বলা অপছন্দ করা

আরবি: عَنْ أَبِي بَرْزَةَ الْأَسْلَمِيِّ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَكْرَهُ النَّوْمَ قَبْلَ الْعِشَاءِ، وَالْحَدِيثَ بَعْدَهَا. বাংলা অনুবাদ: আবু বারযাহ আল-আসলামী (রা.) থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ (সা.) এশার নামাজের পূর্বে ঘুমানো এবং এশার নামাজের পর কথা বলা অপছন্দ করতেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৯৯; মুসলিম, হাদিস: ৬৪৭)

হাদিস ২: রাতের শেষ ভাগে ইবাদতের গুরুত্ব
দ্রুত ঘুমানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাতের শেষ ভাগে উঠে আল্লাহর ইবাদত করা।

আরবি: يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ يَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ.

বাংলা অনুবাদ: “আমাদের প্রতিপালক, বরকতময় ও সুমহান, প্রতি রাতে যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে, তখন তিনি দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেবো? কে আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দেবো? কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো?'” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৪৫; মুসলিম, হাদিস: ৭৫৮)

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দ্রুত ঘুমানোর উপকারিতা:

দ্রুত ঘুমানো বা পর্যাপ্ত ঘুমের উপকারিতা সম্পর্কে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং ঘুম বিশেষজ্ঞরা অসংখ্য গবেষণা করেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান এটিকে শুধু একটি ভালো অভ্যাস হিসেবেই দেখে না, বরং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য একটি অপরিহার্য প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করে।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা:
১. মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি: পর্যাপ্ত ঘুম স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ এবং সৃজনশীলতা বাড়ায়।
২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালীকরণ: ঘুমের সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলো শক্তিশালী হয়, যা শরীরকে রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
৩. হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস: পর্যাপ্ত ঘুম উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা: ঘুম ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন ঘেরলিন (Ghrelin) এবং লেপটিন (Leptin)-এর ভারসাম্য রক্ষা করে, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
৫. মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি: পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা কমিয়ে মেজাজ ভালো রাখতে সাহায্য করে।
৬. শারীরিক শক্তি ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি: ঘুমের সময় শরীরের পেশীগুলো মেরামত হয়, যা শারীরিক শক্তি ও কর্মক্ষমতা বাড়ায়।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান একমত যে, দ্রুত ও পর্যাপ্ত ঘুম একটি সুস্থ এবং দীর্ঘ জীবনযাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button