কচ্ছপ নিয়ে কিছু মজার মজার কথা
মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব
কচ্ছপ চলাচলে একটি ধীরস্থির প্রাণী। কয়েক হাজার বছর আগে প্রখ্যাত লেখক ঈশপ তার বিখ্যাত “কচ্ছপ ও খরগোশ” গল্পে এই ধীরস্থিরতাকেই তুলে ধরেছিলেন। প্রাণী জগতের মধ্যে দৈহিক কাঠামোর দিক থেকে অদ্ভুত হওয়ায় কচ্ছপ সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কচ্ছপ বা কাছিম Testudines বর্গের অন্তর্ভুক্ত সরীসৃপ প্রাণী। বাংলাদেশে সাধারণত ২৭ প্রজাতির কাছিম ও কচ্ছপ পাওয়া যায়। দুঃখের বিষয় হলো, আগে গ্রাম্য জনপদে কচ্ছপ দেখা গেলেও এখন আর তেমন দেখা যায় না। এদের প্রধান শারীরিক বৈশিষ্ট্য হলো একটি বিশেষ অস্থি নির্মিত খোলস, যা এদের পাঁজর থেকে বিকশিত হয়ে পুরো শরীরকে ঢেকে রাখে।
কচ্ছপ প্রধানত দুটি দলে বিভক্ত: পার্শ্ব-ঘাড়ের কচ্ছপ (Side-necked turtles) এবং লুকানো-ঘাড়ের কচ্ছপ (Hidden-necked turtles)। বিপদের সময় মাথা খোলসের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখার পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এই বিভাজন করা হয়েছে। অন্যান্য সরীসৃপদের মতো কচ্ছপেরা বাতাসে শ্বাস নেয় এবং পানির ওপরে ডিম পাড়ে, যদিও এর অনেক প্রজাতি জলেই বা জলের আশেপাশে বাস করে। জেনেটিক প্রমাণ অনুযায়ী, কুমির এবং পাখির সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
কচ্ছপের খোলস মূলত হাড় দিয়ে তৈরি। এর উপরের গম্বুজযুক্ত অংশটিকে ক্যারাপেস (Carapace) এবং নীচের সমতল অংশটিকে প্লাস্ট্রন (Plastron) বলা হয়। খোলসের বাইরের পৃষ্ঠটি কেরাটিন (চুল, শিং এবং নখের উপাদান) দিয়ে তৈরি আঁশ দ্বারা আবৃত থাকে। কচ্ছপ হলো ইктоথার্ম (Ectotherm) বা “ঠান্ডা-রক্তের” প্রাণী, যার অর্থ এদের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা পরিবেশের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এরা সাধারণত সর্বভুক হয়ে থাকে।
সাধারণ মানুষের কাছে জলে বা স্থলে থাকা এই প্রাণীগুলো সবই ‘কচ্ছপ’ বা ‘কাছিম’ বলে পরিচিত হলেও এদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যারা মূলত স্থলে বাস করে, তাদের কচ্ছপ (Tortoise); যারা জলে বাস করে, তাদের কাছিম (Turtle) এবং যারা ঈষৎ লবণাক্ত পানিতে বাস করে, তাদের টেরাপিন (Terrapin) বলা হয়।
কচ্ছপ (Tortoise) ও কাছিমের (Turtle) মধ্যে প্রধান পার্থক্যগুলো হলো:
- বাসস্থান: কচ্ছপ স্থলচর প্রাণী, জীবনের বেশির ভাগ সময় স্থলেই কাটায়। শুধু তৃষ্ণা পেলে বা বিশেষ প্রয়োজনে এরা জলের সংস্পর্শে আসে। অন্যদিকে, কাছিম জলচর প্রাণী।
- খোলস: স্থলে বসবাসের কারণে আত্মরক্ষার জন্য কচ্ছপের পিঠের খোলস অনেক বেশি শক্ত, ভারী ও গম্বুজাকৃতির হয়। অন্যদিকে, কাছিমের খোলস তুলনামূলকভাবে পাতলা, হালকা ও চ্যাপ্টা হয়, যা তাদের সহজেই পানিতে সাঁতার কাটতে সাহায্য করে।
- পা: কচ্ছপের পা হাতির পায়ের মতো মোটা, খাটো এবং মজবুত হয়, যা স্থলে হাঁটার উপযোগী। অন্যদিকে, কাছিমের পায়ের আঙুলগুলো হাঁসের পায়ের মতো পাতলা চামড়া দিয়ে জোড়া লাগানো থাকে, যা সাঁতার কাটার জন্য আদর্শ।
- খাদ্যাভ্যাস: বেশির ভাগ কচ্ছপই তৃণভোজী (শাকসবজি, ফলমূল খায়)। অন্যদিকে, কাছিম সর্বভুক; এরা মাছ, মাংস, জলজ উদ্ভিদ—সবই খায়।
- আয়ুষ্কাল: কচ্ছপ পৃথিবীর দীর্ঘজীবী প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। এরা সাধারণত ৬০ থেকে ৮০ বছর বাঁচে, কিছু প্রজাতি শত বছরেরও বেশি বাঁচে। সে তুলনায় কাছিমের জীবনকাল অনেক কম, মাত্র ২০ থেকে ৪০ বছর।
জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং কচ্ছপ ও কাছিমের সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর ২৩শে মে ‘বিশ্ব কাছিম দিবস’ পালিত হয়। ২০০০ সালে ‘আমেরিকান টরটয়েজ রেসকিউ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান এই দিবসটির সূচনা করে।
পৃথিবীর প্রায় সব উষ্ণ সাগরে সামুদ্রিক কাছিমদের বিচরণ রয়েছে। এরা জীবনের প্রায় সব কাজ—যেমন খাবার গ্রহণ, মিলন ইত্যাদি—সাগরে সারলেও ডিম পাড়ার জন্য স্ত্রী কাছিমকে সৈকতে আসতেই হয়। ডিম পাড়ার জন্য এরা অত্যন্ত নির্জন স্থান বেছে নেয় এবং কোনো ধরনের বিপদ আঁচ করতে পারলে ডিম না পেড়েই পুনরায় সাগরে ফিরে যায়। মা কাছিম বা কচ্ছপেরা ডিম পাড়ার জন্য গর্ত খুঁড়ে সেখানে প্রজাতিভেদে ১ থেকে ৩০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। তারা সাধারণত রাতের বেলায় ডিম পাড়ে এবং ডিম পাড়ার পর সেগুলো বালি, মাটি বা অন্য কোনো জৈব পদার্থ দিয়ে ঢেকে দেয়। এরপর মা কচ্ছপ ডিমগুলোকে প্রকৃতির দায়িত্বে রেখেই নিজের আবাসে চলে যায়।
প্রজাতিভেদে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ৬০ থেকে ১২০ দিন সময় লাগে। ডিম ফোটার জন্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। ডিম ফুটে বাচ্চাগুলো বেরিয়েই নদী, জলাশয় বা সাগরের দিকে পাড়ি জমায়। মজার ব্যাপার হলো, পুরুষ সামুদ্রিক কাছিম ডিম ফুটে বের হয়ে একবার সাগরে চলে গেলে আর কখনো সৈকতে ফিরে আসে না; তার সমগ্র জীবনচক্র সাগরেই কেটে যায়।
পৃথিবীতে সাধারণত ৭ প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম রয়েছে, যার মধ্যে ৪টি প্রজাতিকেই বিপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই সাত প্রজাতির মধ্যে লেদারব্যাক সি টার্টেল (Leatherback Sea Turtle) আকারের দিক থেকে সবচেয়ে বড়। এদের সামনের ফ্লিপারটি (ডানা) লম্বায় প্রায় নয় ফুট পর্যন্ত হতে পারে। অন্যান্য কাছিমের পিঠের অংশ শক্ত খোলস দিয়ে আবৃত থাকলেও এদের পিঠ তৈলাক্ত ও চামড়াসদৃশ মাংসল অংশ দিয়ে গঠিত, যে কারণে এর এমন নামকরণ। প্রজাতিভেদে এদের পরিযায়ী হওয়ার বৈশিষ্ট্যেও অনেক পার্থক্য দেখা যায়। যেখানে গ্রিন সি টার্টেল (Green Sea Turtle) আটলান্টিক মহাসাগরে প্রায় ১৩০০ মাইল পথ পাড়ি দেয়, সেখানে স্ত্রী লেদারব্যাক সি টার্টেল প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে প্রায় ১২,০০০ মাইল পথ ভ্রমণ করে। এসব সামুদ্রিক কাছিমের গড় আয়ু প্রায় ৫০ বছর এবং এদের খাবারের তালিকায় সামুদ্রিক আগাছাসহ ছোট স্কুইড ও মাছ রয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো, ডিম ফুটে প্রায় সব বাচ্চা বের হলেও নানা প্রতিকূলতার কারণে খুব কম সংখ্যক বাচ্চাই পূর্ণবয়স্ক হতে পারে।
অধিকাংশ কচ্ছপ প্রজাতিতে স্ত্রী ও পুরুষ সদস্য আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। কিছু প্রজাতির পুরুষদের ঘাড় স্ত্রীদের চেয়ে লম্বা হয়, আবার কিছু প্রজাতির স্ত্রীদের নখ পুরুষদের চেয়ে বড় হয়ে থাকে। অধিকাংশ কেষত্রে স্ত্রী কচ্ছপেরা পুরুষদের চেয়ে আকারে বড় হয়। প্রজনন সুবিধার জন্য পুরুষ কচ্ছপের প্লাস্ট্রন বা পেটের দিকের খোলসটি ভিতরের দিকে কিছুটা বাঁকানো থাকে। কচ্ছপের লিঙ্গ নির্ধারণের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো তাদের লেজ পর্যবেক্ষণ করা। সাধারণত স্ত্রীদের লেজ নিচের দিকে বাঁকানো ও ছোট হয়, অন্যদিকে পুরুষদের লেজ ওপরের দিকে বাঁকানো এবং তুলনামূলকভাবে বড় থাকে।
অধিকাংশ স্থলচর কচ্ছপ তৃণভোজী; এরা ঘাস, আগাছা, পাতা, ফুল এবং ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। তবে কিছু সর্বভুক কচ্ছপও রয়েছে, যারা পোকামাকড় এবং মৃতদেহও খায়। তৃণভোজী কচ্ছপদের জন্য অতিরিক্ত আমিষ গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, কারণ এটি খোলসের বিকৃতিসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যগত জটিলতা সৃষ্টি করে।
সনাতন ধর্মে কচ্ছপ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে। কূর্ম অবতার হলেন ভগবান বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার, যিনি সত্য যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ভগবান বিষ্ণু এই অবতারে শরীরের উপরের অংশ মানুষের এবং নিচের অংশ কচ্ছপের রূপ ধারণ করেন। সমুদ্র মন্থনের সময় তার পিঠে মন্দার পর্বত স্থাপন করে মন্থনকার্য সম্পন্ন হয়েছিল। এছাড়া, প্রাচীন চীনে কচ্ছপের খোলস ভবিষ্যদ্বাণী করতে ব্যবহৃত হতো এবং প্রাচীন গ্রিক দেবতা হার্মিসের প্রতীকও ছিল কচ্ছপ।
কচ্ছপের খোলসের ওপরের অংশে যে সমকেন্দ্রিক বলয় থাকে, তা থেকে তাদের বয়স সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়, যেমনটি গাছের ক্ষেত্রে বর্ষবলয় দেখে পাওয়া যায়। কিছু কিছু কচ্ছপের ১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচার কথাও শোনা যায়। এদের দীর্ঘ আয়ুর পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে। কচ্ছপদের ক্যান্সারের হার ধারাবাহিকভাবে ১ শতাংশেরও নিচে, যেখানে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এই হার প্রায় ১০ শতাংশ। এর কারণ হলো কচ্ছপের বিপাক ক্রিয়া অত্যন্ত ধীর এবং এদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী।
পরিশেষে বলা যায়, নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট, ঝোপ-ঝাড় ধ্বংস, পানি দূষণ, খাদ্যাভাব এবং মানুষের নির্বিচারে শিকারের কারণে পরিবেশের বন্ধু কচ্ছপ আজ হারিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর ২৭০ প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে প্রায় ১০০টি প্রজাতিই বিপন্ন। অবৈধ শিকার, বাণিজ্য ও খাদ্য হিসেবে গ্রহণের কারণে এদের অস্তিত্ব আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। এসব কারণে বাংলাদেশের কাছিম ও কচ্ছপের সব প্রজাতিই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। উল্লেখ্য যে, সাতক্ষীরা, খুলনা, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জেও কাছিম ও কচ্ছপের বেচাকেনা এবং খাদ্য হিসেবে গ্রহণের প্রবণতা দেখা যায়। সাধারণত অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এর মাংস খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।
তবে আশার কথা, বর্তমানে প্রকৃতির বন্ধু এই প্রাণীগুলোকে রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে “পরিবেশ বন্ধু কাছিম, প্রকৃতিতে বাঁচতে দিন”—এই স্লোগানের আওতায় সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু হয়েছে।
এটি সত্য যে, নদী-পুকুরের পানি পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে কচ্ছপ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিপন্ন এই প্রাণী যাতে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে না যায়, সে ব্যাপারে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এই বিশ্বে কোনো জীবই অকারণে সৃষ্টি হয়নি; প্রত্যেকেরই নিজস্ব প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে এদের ভূমিকা খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
জলাশয়ে বা নদীতে কাছিম থাকলে সেখানকার পানি পরিষ্কার থাকে এবং জলজ বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বজায় থাকে, যা সেই জলাশয়ের সার্বিক অবস্থাকে উন্নত করে। কাছিম নদীর তলদেশের পচা-গলা আবর্জনা খেয়ে পানিকে দূষিত হওয়া থেকে বাঁচায়। এছাড়া, কাছিম নদীর তলদেশের মাটি আলোড়িত করে, যা অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্য অনুসন্ধানে সহায়তা করে।
সনাতন ধর্ম মতে, কচ্ছপ সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি, সম্পদ এবং শান্তি আকর্ষণ করতে সহায়তা করে বলে বিশ্বাস করা হয়।



