পরিবেশবৈশ্বিকসংগৃহীত সংবাদ

সমুদ্রের সেই লৌহবর্মী শাসক: যার সামনে হাঙ্গরও ছিল অসহায়

প্রায় ৩৬ থেকে ৩৮ কোটি বছর আগের কথা, যখন পৃথিবীতে ডাইনোসরদের আবির্ভাবও ঘটেনি, তখন সমুদ্রের একচ্ছত্র অধিপতি ছিল এক ভয়ংকর শিকারি। তার নাম ডান্কলিওস্টিয়াস। এটি কেবল একটি মাছ ছিল না, ছিল প্রাগৈতিহাসিক মহাসাগরের এক জীবন্ত ট্যাংক, যার বর্মভেদী চোয়ালের সামনে কোনো প্রাণীই নিরাপদ ছিল না। চলুন ডুব দেওয়া যাক ডেভোনিয়ান যুগের সেই অতল সমুদ্রে এবং পরিচিত হওয়া যাক এই অদ্ভুত কিন্তু ভয়ংকর শিকারির সঙ্গে।

কে ছিল এই ডান্কলিওস্টিয়াস?

ডান্কলিওস্টিয়াস ছিল ‘প্ল্যাকোডার্ম’ (Placoderm) বা বর্মযুক্ত মাছদের দলের সদস্য। এরা ছিল পৃথিবীর প্রথম চোয়ালযুক্ত মাছদের মধ্যে অন্যতম। ডেভোনিয়ান যুগে (Devonian Period), যা “মাছেদের যুগ” নামে পরিচিত, ডান্কলিওস্টিয়াস ছিল খাদ্যশৃঙ্খলের শীর্ষে থাকা এক শিকারি বা Apex Predator। এর জীবাশ্ম উত্তর আমেরিকা, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং মরক্কোর মতো বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে যে একসময় বিশ্বজুড়ে এর বিচরণ ছিল।

দৈত্যের মতো চেহারা ও লৌহবর্ম

ডান্কলিওস্টিয়াসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং ভয়ংকর বৈশিষ্ট্য ছিল তার বিশাল সাঁজোয়াযুক্ত মাথা। পুরো শরীর আঁশবিহীন হলেও মাথা এবং ঘাড়ের অংশটুকু ছিল পুরু ও ধারালো হাড়ের বর্মে ঢাকা। এই বর্ম তাকে অন্য শিকারিদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করত। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এর শরীরের বাকি অংশ নরম ও তরুণাস্থি দিয়ে গঠিত ছিল, যার কারণে মাথার বর্ম ছাড়া বাকি অংশের জীবাশ্ম খুব একটা পাওয়া যায় না।

আকারে এই মাছটি বিশাল ছিল। একটি পূর্ণবয়স্ক ডান্কলিওস্টিয়াস প্রায় ১১ থেকে ১৩ ফুট (প্রায় ৪ মিটার) লম্বা হতো এবং এর ওজন এক টনেরও বেশি হতে পারত। যদিও কিছু পুরনো ধারণা অনুযায়ী একে প্রায় ৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা বলা হতো।

দাঁতহীন, কিন্তু ভয়ংকর চোয়াল

ডান্কলিওস্টিয়াসের কোনো দাঁত ছিল না! তবে দাঁতের চেয়েও ভয়ংকর কিছু তার ছিল। এর চোয়ালের হাড়গুলোই ধারালো ব্লেডের মতো অংশে পরিণত হয়েছিল। মুখ খোলা বা বন্ধ করার সময় এই হাড়ের ব্লেডগুলো একে অপরের সঙ্গে ঘষা লেগে ছুরির মতো ধারালো হয়ে যেত। এর কামড় ছিল অনেকটা গোটিনের মতো, যা দিয়ে শিকারকে এক আঘাতে দুই টুকরো করে ফেলতে পারত।

বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, ডান্কলিওস্টিয়াসের কামড়ের জোর ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী। এর চোয়ালের ডগায় কামড়ের চাপ ছিল প্রায় ৮০,০০০ পিএসআই (PSI), যা ভয়ংকর টির‍্যানোসরাস রেক্স (T-Rex) বা কুমিরের কামড়ের শক্তির সঙ্গে তুলনীয়। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, এটি মাত্র এক সেকেন্ডের ৫০ ভাগের এক ভাগ সময়ে তার বিশাল মুখ খুলতে পারত, যা একটি ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থান তৈরি করে শিকারকে মুখের ভেতরে টেনে নিত।

কী খেত এই জলদানব?

খাদ্যশৃঙ্খলের শীর্ষে থাকায় ডান্কলিওস্টিয়াসের খাবারের তালিকায় প্রায় সবই ছিল। সে সময়ের ছোট-বড় সব সামুদ্রিক প্রাণী, এমনকি প্রাগৈতিহাসিক হাঙ্গর, শক্ত খোলসযুক্ত অ্যামোনাইট (Ammonite) এবং নিজের প্রজাতির অন্য সদস্যদেরও শিকার করত। এর শক্তিশালী চোয়াল অন্য বর্মযুক্ত মাছদের শক্ত বর্ম ভেঙে ফেলতেও সক্ষম ছিল। তবে জীবাশ্ম পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এটি শিকারের হাড় হজম করতে পারত না এবং পরে তা উগরে দিত।

বিলুপ্তি

প্রায় ৩৬ কোটি বছর আগে ডেভোনিয়ান যুগের শেষের দিকে এক ভয়াবহ গণবিলুপ্তির ঘটনা ঘটে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সমুদ্রের জলে অক্সিজেনের মাত্রা মারাত্মকভাবে কমে যাওয়াই ছিল এর প্রধান কারণ। এই পরিবর্তিত পরিবেশে ডান্কলিওস্টিয়াসের মতো বিশাল আকারের প্রাণীদের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় এই লৌহবর্মী শিকারি।

ডান্কলিওস্টিয়াস হয়তো আজ আর নেই, কিন্তু তার জীবাশ্ম আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কোটি কোটি বছর আগে আমাদের এই পৃথিবীর সমুদ্রগুলো ছিল কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি রহস্যময় এবং ভয়ংকর প্রাণীদের বিচরণক্ষেত্র।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button