ইসলাম ধর্ম

সূরা আল-আনফালের ২২ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা

ইসলামিক ডেস্ক: সত্যকে জেনেও যারা উপলব্ধি করে না, তাদের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আসুন জেনে নিই সেই আয়াতের गहन অর্থ ও শিক্ষা।

“নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে বিচরণকারী জীবদের মধ্যে তারাই সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট, যারা (সত্য কথা শোনার ক্ষেত্রে) বধির এবং (সত্য কথা বলার ক্ষেত্রে) বোবা, যারা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে না।” (সূরা আল-আনফাল, ৮:২২)

সূরা আল-আনফাল মূলত বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে। এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সেইসব লোকের নিন্দা করেছেন, যারা সত্য বার্তা শোনার পরও নিজেদের অহংকার, জেদ এবং খেয়াল-খুশির কারণে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে।

এখানে ‘বধির’ ও ‘বোবা’ শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দ্বারা শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বোঝানো হয়নি; বরং তাদের বোঝানো হয়েছে, যাদের কানে সত্য পৌঁছানোর পরও তারা তা শুনতে চায় না এবং জিহ্বা থাকা সত্ত্বেও সত্য কথা বলে না।

আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, “যারা বিবেক বা বুদ্ধি ব্যবহার করে না (لَا يَعْقِلُونَ)”। এর মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ প্রদত্ত কান, চোখ ও হৃদয়কে তারা চিন্তা-গবেষণা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কাজে ব্যবহার না করে অবহেলা করে।

তাদের ‘নিকৃষ্ট’ বলার কারণ

  1. ইচ্ছাকৃত অবহেলা: মানুষ হিসেবে তাদের শোনার, দেখার ও চিন্তা করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা সত্যকে স্বেচ্ছায় এড়িয়ে যায়।
  2. হৃদয়ে মোহর পড়ে যাওয়া: বারবার সত্যকে অস্বীকার করার ফলে তাদের হৃদয় কঠিন হয়ে যায় এবং সত্য গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে (যেমনটি সূরা আল-বাকারা, ২:৭ এবং আল-আন‘আম, ৬:১১০-এ বর্ণিত হয়েছে)।
  3. সামাজিক ক্ষতি: তারা নিজেরা সত্য গ্রহণ করে না এবং অন্যকেও সত্য গ্রহণে বাধা দেয়। এ কারণে তাদের অবস্থান চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও অধম বলা হয়েছে (সূরা আল-আ‘রাফ, ৭:১৭৯)।

এই আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়

  • মনোযোগ দিয়ে শোনা: ঈমানের প্রথম ধাপ হলো কোরআন-সুন্নাহ ও সত্য কথা শোনার জন্য মনকে প্রস্তুত রাখা (সূরা আয-যুমার, ৩৯:১৮)।
  • বুদ্ধিবৃত্তিক বিচার: ইসলাম অন্ধ অনুকরণকে নিরুৎসাহিত করে। তাই যেকোনো বিষয় প্রমাণসহ বুঝে গ্রহণ করার জন্য ‘আক্বল’ বা বুদ্ধিকে সক্রিয় করতে বলা হয়েছে।
  • সত্য বলা ও সমর্থন করা: কোনো অন্যায় দেখলে তা হাত, জিহ্বা বা অন্তত অন্তর দিয়ে পরিবর্তনের চেষ্টা করার নির্দেশ রয়েছে (সহীহ মুসলিম)। সত্য জেনেও চুপ থাকা একটি বড় পাপ।
  • কৃতজ্ঞতা ও আমল: কান, চোখ ও হৃদয় আল্লাহর নেয়ামত। এগুলোকে পাপের কাজে লিপ্ত না করে ইবাদত ও কল্যাণের পথে ব্যবহার করা আবশ্যক।
  • অহংকার ত্যাগ: আত্ম-অহমিকা ও দলাদলি সত্য গ্রহণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। বিনয়ী মনোভাব সত্যকে গ্রহণ করা সহজ করে তোলে।
  • সৎ সঙ্গ অবলম্বন: হেদায়েতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সাহচর্য সত্য শোনার ও বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

একটি সাধারণ ভুল বোঝাবুঝির অবসান

ইসলাম শারীরিকভাবে বধির বা বোবা ব্যক্তিদের কখনোই হেয় করে না। এই আয়াতটি তাদের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়নি। স্বয়ং নবীজি (ﷺ) দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবি আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম (রা.)-কে অত্যন্ত সম্মান দিয়েছেন এবং মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করেছিলেন। এখানে আল্লাহ কেবল নৈতিক বধিরতা ও মূকতার নিন্দা করেছেন।

আত্মশুদ্ধির ব্যবহারিক পথনির্দেশ

১. প্রতিদিন কিছু সময় কোরআন তিলাওয়াত, এর অর্থ অনুধাবন (তাদাব্বুর) এবং সহিহ জ্ঞানচর্চায় ব্যয় করা।
২. সত্য জানার পর দ্রুত তা গ্রহণ করা এবং নিজের ভুল বুঝতে পারলে স্বীকার করে সংশোধন করা।
৩. কথা বলার আগে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা; গুজব ও অপ্রমাণিত খবর ছড়ানো থেকে বিরত থাকা (সূরা আল-হুজুরাত, ৪৯:৬)।
৪. কোনো অন্যায় দেখলে নম্রভাবে সংশোধনের চেষ্টা করা, যা অন্তত নিজের পরিবার বা সমাজ থেকে শুরু হতে পারে।
৫. আল্লাহর কাছে জ্ঞান ও হেদায়েতের জন্য দোয়া করা:
* رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا — “হে আমার প্রতিপালক, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।” (সূরা ত্ব-হা, ২০:১১৪)
* رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا — “হে আমাদের প্রতিপালক, (সঠিক পথ দেখানোর পর) আমাদের হৃদয়কে বক্র করে দেবেন না।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:৮)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button