পরিবেশবাংলাদেশ

ডিমলায় বিলুপ্তির পথে ফুটবল: মাঠ হারাচ্ছে প্রাণ, বাড়ছে মাদকাসক্তি

বিশেষ প্রতিনিধি: নীলফামারীর সীমান্তবর্তী উপজেলা ডিমলা। একসময় এই উপজেলার গ্রামেগঞ্জে ফুটবল ছিল অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। স্কুল মাঠ, গ্রামের খোলা জায়গা কিংবা পাড়ার ময়দান—যেখানেই সামান্য জায়গা পাওয়া যেত, বিকেলের আড্ডা জমে উঠত ফুটবলকে ঘিরে। খেলার উল্লাসে মাঠ-ঘাট শিশু-কিশোরদের হাসি-চিৎকারে মুখর থাকত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই মাঠগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। জমির দখল, বাজার স্থাপন, স্থাপনা নির্মাণ ও অবহেলার কারণে মাঠগুলো এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। মাঠ হারানোর সঙ্গে সঙ্গে শুধু খেলার সুযোগই নয়, একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার পথও রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।

ডিমলার একসময়ের প্রাণবন্ত মাঠগুলো আজ আর আগের মতো নেই। অনেক মাঠ দখল হয়ে গেছে, কোনোটি আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে, আবার কোথাও মাঠের জায়গায় গড়ে উঠেছে পাকা স্থাপনা। উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে খেলার উপযুক্ত কোনো মাঠই নেই। সরকারি হিসাবে উপজেলায় মাত্র একটি বড় মাঠ থাকলেও জনসংখ্যার তুলনায় তা অত্যন্ত অপ্রতুল।

স্থানীয়রা বলছেন, যেখানে একসময় প্রতি বিকেলে শত শত শিশু ফুটবল খেলত, এখন সেই মাঠগুলোতে কেবলই নীরবতা। ফুটবল খেলার পরিবেশ না থাকায় শিশুরা মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট গেমস, অনলাইন জুয়া এবং মাদকের মতো ক্ষতিকর বিষয়ে ঝুঁকে পড়ছে।

খেলাধুলা শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি একটি সামাজিক শক্তি। বিশেষ করে ফুটবল তরুণদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। নিয়মিত খেলাধুলা শরীরকে সুস্থ রাখে, মানসিক চাপ কমায়, শৃঙ্খলা শেখায় এবং দলবদ্ধভাবে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করে।

স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক রাশেদ খান বলেন, “ফুটবল তরুণদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে এবং তাদের প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করে। মাঠ না থাকায় তারা এখন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, ফলে ভুল পথে যাওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।”

উপজেলার নাউতারা ইউনিয়নের তরুণ ফুটবলার রুবেল হোসেন ছোটবেলা থেকেই জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখতেন, কিন্তু এখন সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে। তিনি বলেন, “মাঠ নেই, প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই। খেলাধুলার অভাবে ফুটবল ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে হচ্ছে। অথচ আমাদের মধ্যে অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে।”

স্থানীয় ফুটবলপ্রেমী সামিউল ইসলাম বলেন, “ডিমলার মাঠগুলো যদি খেলার উপযোগী থাকত, তাহলে অনেক তরুণ জাতীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ পেত। কিন্তু সুযোগের অভাবে প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে শুধু খেলোয়াড়রাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, সমাজও হারাচ্ছে তার ইতিবাচক শক্তি।”

উপজেলার ক্রীড়া সংগঠকদের মতে, মাঠ সংকট ও খেলাধুলার সুযোগের অভাবে ডিমলার তরুণদের একটি বড় অংশ বিপথে যাচ্ছে। ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি অনলাইন জুয়া ও টিকটকের মতো ক্ষতিকর আসক্তিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

স্থানীয় অভিভাবকরা জানান, সন্তানদের মাঠে নিয়ে যাওয়ার মতো জায়গা নেই। ফলে তারা সারাদিন মোবাইল ফোনে সময় কাটায়, যা তাদের পড়াশোনা ও চরিত্র—দুয়েরই ক্ষতি করছে।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, ডিমলায় প্রচুর তরুণ খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রতিভা বিকাশের কোনো সুযোগ নেই। স্থানীয় ফুটবলপ্রেমীরা মনে করেন, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি ও প্রবাসী সমাজসেবকরা এগিয়ে এলে ফুটবলের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব। নিয়মিত টুর্নামেন্ট আয়োজন, প্রশিক্ষণ, মাঠ সংস্কার ও ক্রীড়া একাডেমি স্থাপন করা গেলে ডিমলার তরুণরা আবারও জাতীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ পাবে।

স্থানীয় ফুটবলপ্রেমী জাহিদুল ইসলাম বলেন, “ডিমলার মাটিতে অসংখ্য প্রতিভা লুকিয়ে আছে। শুধু একটু সুযোগ পেলেই তারা দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে। ফুটবলকে বাঁচাতে হলে আগে মাঠ ফিরিয়ে দিতে হবে।”

এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরানুজ্জামান বলেন, “তরুণদের সুস্থ বিনোদনের জন্য খেলাধুলার বিকল্প নেই। আমরা কয়েকটি মাঠ সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়েছি। পাশাপাশি বিদ্যালয় পর্যায়ে ক্রীড়া কার্যক্রম সক্রিয় করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। মাঠ রক্ষা ও নিয়মিত টুর্নামেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে তরুণদের খেলাধুলায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”

তিনি আরও বলেন, “খেলাধুলার মাধ্যমে তরুণদের মাদক ও অপরাধ থেকে দূরে রাখা যায়। এ জন্য প্রশাসন সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে।”

প্রত্যন্ত এই অঞ্চলে একসময় ফুটবলের গোলের উল্লাসে মাঠ কেঁপে উঠত, সেখানে আজ বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ, আর তার সাথে হারিয়ে যাচ্ছে একটি প্রজন্মের স্বপ্ন। এখনই উদ্যোগ না নিলে হয়তো ফুটবল ডিমলার ইতিহাসে কেবলই এক স্মৃতি হয়ে থাকবে। তবে আশার আলো এখনো নিভে যায়নি। স্থানীয় জনগণ, প্রশাসন এবং সমাজসেবকরা একসঙ্গে এগিয়ে এলে আবারও মাঠে ফিরতে পারে ফুটবল, আর শিশুদের কলরবে মুখর হতে পারে ডিমলার হারানো প্রাণশক্তি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button