ঘুষ ও অর্থ আত্মসাতে শাস্তিমূলক বদলি হয়েও থামেননি সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম

মুহাম্মদ জুবাইর: নারী কেলেঙ্কারি ও অর্থ আত্মসাতের কারণে নেত্রকোনার উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলামকে শাস্তিমূলকভাবে বান্দরবানের থানচি উপজেলায় বদলি করা হয়েছিল। তবে বদলির কয়েক মাসের মধ্যেই পদোন্নতি পেয়ে তিনি বান্দরবান জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হন। দুর্গম এলাকায় বদলির উদ্দেশ্য ছিল তার আগের কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে সংশোধন করা, কিন্তু বান্দরবানে আসার পর চিত্র পুরোটাই উল্টে গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে তিনি আগের চেয়েও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ২০২৫ সালের ১৭ মে সহকারী পরিচালক পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর তিনি আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বদলি বাণিজ্য শুরু করেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ের নারী কর্মীদের কুপ্রস্তাব ও যৌন হেনস্তা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি, সরকারি চাকুরি নীতিমালা লঙ্ঘন করে তিনি বিনা ভাড়ায় মাতৃমঙ্গল কেন্দ্রের গেস্ট হাউসকে নিজের ব্যক্তিগত আবাস হিসেবে ব্যবহার করছেন।
অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে নেত্রকোনা সদর উপজেলায় কর্মরত থাকাকালে নারী কর্মীদের উত্ত্যক্ত ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রফিকুলের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় তাকে শাস্তিমূলকভাবে বান্দরবানের থানচি উপজেলায় বদলি করা হয়। থানচিতে যোগ দিয়ে তিনি বেশিরভাগ সময় অফিসে না এসেই বেতন-ভাতা তুলতেন। চলতি বছরের ১৭ মে পদোন্নতি পেয়ে বান্দরবান জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। পদোন্নতি পেয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এবং রুমা উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বও নেন।
বান্দরবানে যোগদানের পর তিনি দিনের চেয়ে রাতের বেলায় বেশি অফিস করতে শুরু করেন। রাত ১১টায় অফিসে গিয়েও তাকে চেয়ারে পাওয়া গেছে। গোপন সূত্রে জানা যায়, তিনি অফিসিয়াল সিকিউরিটি ক্যামেরা বন্ধ করে রাতে কাজ করেন এবং মাতৃমঙ্গল কেন্দ্রের গেস্ট হাউসে রাত কাটান। অভিযোগ রয়েছে, কোনো নারী কর্মীকে পছন্দ হলে তাকে সেবামূলক কাজের নামে রাতে ডিউটিতে ডেকে পাঠান এবং রাত গভীর হলে অনৈতিক প্রস্তাব দেন। কেউ প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানালে তার বিরুদ্ধে কর্মক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বদলি বাণিজ্য শুরু করেন।
সাবেক কর্মস্থলের সূত্র জানায়, তার স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি নৈতিকতা হারিয়েছেন। স্ত্রীর চিকিৎসার নামে তিনি উপজেলা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন, এমনকি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছেও অর্থ চেয়েছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অফিসের কয়েকজন কর্মী জানান, রাতের আঁধারে সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে তিনি বদলি বাণিজ্যের তালিকা তৈরি ও লেনদেন করেন। পছন্দের নারী কর্মীকে ভালো জায়গায় রেখে অপছন্দের কর্মীকে দুর্গম এলাকায় পাঠান। তার প্রস্তাবে সাড়া না দিলে দুর্গম থেকে দুর্গমতম এলাকায় বদলির হুমকি দেন। গত ৭ আগস্ট এক মাসেই তিনি ছয়জন নারী কর্মীসহ প্রায় এক ডজন কর্মীকে বদলি করেছেন। যারা লেনদেন করেছেন বা তার অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন, তারা ভালো জায়গায় আছেন। যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল এবং তার চাহিদা মতো লেনদেন করতে পারেননি, তাদের দুর্গম এলাকায় পাঠানো হয়েছে।
বদলি হওয়া ও হুমকির শিকার কয়েকজন কর্মী জানান, জেলা অফিসের কর্মীদের নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তাদের সহযোগিতায় তিনি বদলি বাণিজ্য চালাচ্ছেন এবং লেনদেনের টাকার ভাগ জেলা অফিসের কর্মীরাও পান। একারণে সহজে কেউ মুখ খুলতে চায় না। যাদের বদলি করানো হয়, তাদের পছন্দের জায়গায় থাকতে হলে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়, অন্যথায় দুর্গম এলাকায় পাঠিয়ে পদ শূন্য করা হয় এবং পরে সেই পদে পছন্দের প্রার্থীকে বসানো হয়।
কয়েকজন নারী কর্মী জানান, সহকারী পরিচালকের আচরণ নারীদের ক্ষেত্রে আপত্তিকর এবং তার দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন। সংসার বাঁচানোর তাগিদে পরিবারের কাছে এসব কথা বলতেও পারছেন না তারা। কখন কী ঘটে যায়, সেই আতঙ্ক নিয়ে অফিস করতে হচ্ছে। তারা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। তারা বলেন, যদি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, তবে তদন্ত কমিটির কাছে তারা তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নোংরামির কথা প্রকাশ করবেন।
এসব বিষয়ে বান্দরবান জেলা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কর্তৃপক্ষ আমাকে বেশি ভালোবাসেন, তাই এখানে বদলি করেছেন।” রাতে অফিস করার কারণ হিসেবে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করার কথা বলেন। তবে মাতৃমঙ্গল গেস্ট হাউসে রাত্রি যাপন ও সিসি ক্যামেরা বন্ধ করার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে দ্রুত সরে পড়েন।
বিনা ভাড়ায় গেস্ট হাউসে থাকার বিষয়ে জানতে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডা. কামরুল মনি রিবনকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অন্যদিকে, জেলা পরিবার পরিকল্পনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. লেনিন তালুকদার জানান, অফিসের সিসি ক্যামেরা ঠিক আছে এবং বন্ধ করা হয় না। তিনি বলেন, অফিস সময়ের পর অফিসে অবস্থান করা অনিয়ম।
চট্টগ্রাম পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক আবু সালেহ মো. ফোরকান উদ্দিন বলেন, “মানুষকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হয়। যদি তিনি আবারও আগের মতো আচরণ করেন, তবে আপনারা সঠিক তথ্য তুলে ধরুন।” তিনি রফিকুল ইসলামকে শাস্তিমূলকভাবে বান্দরবানে বদলির বিষয়টিও স্বীকার করেন।
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বান্দরবানে বদলি করাকে স্থানীয়রা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন। তাদের দাবি, এসব কর্মকর্তাদের এখানে পাঠিয়ে এলাকার শান্তি বিনষ্ট করা হচ্ছে।



