৮ দফা দাবি আদায়ে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম, দেশব্যাপী আমরণ অনশনের হুমকি সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের

নিজস্ব প্রতিবেদক: মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থা কিংবা যেকোনো ক্রান্তিকালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন ও সহিংসতা সংঘটিত হয়ে আসছে। আপনারা অবগত আছেন, ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ন্যায্যতাকে সমর্থন করে দেশের ছাত্র-জনতা যে আন্দোলন করেছে, তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আমরা, অর্থাৎ দেশের ৮% সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, রাজপথে ছিলাম। অথচ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে তৎকালীন সরকারের পদত্যাগের পরপরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংস নির্যাতন শুরু হয়েছে, যা এখনো চলমান। ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন’-এর সূত্রানুযায়ী, সারাদেশের প্রায় ৩৫টি জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার, লুটপাট, হত্যা, নারীর শ্লীলতাহানি, প্রতিমা ভাঙচুর, মন্দির ভাঙচুর, গির্জায় হামলা এবং বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
আপনারা অবগত আছেন যে, এই সকল ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গত ৯ আগস্ট ২০২৪ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও সচেতন অভিভাবকদের প্রতিনিধিত্ব, সহযোগিতা ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ঢাকায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানেও একইভাবে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবাদ সমাবেশে সকল ধর্মীয় সংগঠন ও সাধারণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্মতিক্রমে ৮ দফা যৌক্তিক দাবি পেশ করা হয়।
গত ১৩ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন’-এর সাধারণ শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আলোচনা সম্পন্ন হয়। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, তাঁরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণসহ ৮ দফা দাবি যথাযথ বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। পাশাপাশি, ৮% জনগোষ্ঠীর সকলের মতামত নিয়ে ৮ দফা দাবিকে চূড়ান্তভাবে সাজানোর পরামর্শ দেন, যেন তারা সকলের জন্য কাজ করতে পারেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, দেশের পিছিয়ে পড়া দলিত ও তফসিলি সম্প্রদায় থেকে শুরু করে আদিবাসী প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আমরা ৮ দফায় সকলের দাবি অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করি, যার ফলে এই ৮ দফা ৮% জনগোষ্ঠীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের সনদে পরিণত হয়েছে।
সংশোধিত ও চূড়ান্ত ৮ দফা
১. ক) সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।
খ) বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন করতে হবে।
২. ক) সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। তার পূর্বে সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করতে হবে এবং বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সাম্প্রদায়িক হামলার তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি প্রদান এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করতে হবে।
খ) আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩. গণপরিষদের নির্বাচনে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা অথবা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সরকারে, সংসদে এবং জনপ্রতিনিধিত্বশীল সকল সংস্থায় অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৪. “হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট”কে “হিন্দু ফাউন্ডেশন”-এ, “বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট”কে “বৌদ্ধ ফাউন্ডেশন”-এ এবং “খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট”কে “খ্রিস্টান ফাউন্ডেশন”-এ উন্নীত করতে হবে।
৫. ক) দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
খ) হরিজন, দলিত, তেলেগু ও চা-শ্রমিকদের বাসস্থান তাদের নামে স্থায়ীভাবে বরাদ্দ করতে হবে।
গ) পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ন্যূনতম ৮০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে।
৬. ক) সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ এবং প্রতিটি হোস্টেলে প্রার্থনা কক্ষ বরাদ্দ করতে হবে।
খ) সংবিধানের ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদের আলোকে তফসিলি সম্প্রদায়ের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. ক) সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড আধুনিকায়ন করতে হবে।
খ) আদিবাসীসহ সকল ভাষাভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশে উদ্যোগ নিতে হবে।
৮. শারদীয় দুর্গাপূজায় ৫ দিন, ইস্টার সানডে-তে ১ দিন, প্রবারণা পূর্ণিমায় ১ দিন এবং বৈসাবিতে ১ দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করতে হবে।
ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন কোনো দাবি নিয়ে কাজ পরিলক্ষিত হয়নি, তখন ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন’-এর শিক্ষার্থী প্রতিনিধি সুস্মিতা কর আমরণ অনশন ব্রত গ্রহণ করেন, যা ঢাকাস্থ রমনা কালী মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়। এ বিষয়ে আমরা প্রায় সকল গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলাম, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, কোনো জাতীয় গণমাধ্যমকে এ নিয়ে যোগাযোগ করতে দেখা যায়নি। এমনকি তখন রমনা কালী মন্দিরের সামনে সোহরাওয়ারী উদ্যানে চলমান বইমেলায় কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্টল ছিল, যারা অনশন চলতে দেখার পরেও বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিল। গণমাধ্যমের এ ধরনের আচরণ আমাদের ব্যথিত করেছিল।
দীর্ঘ ৯২ ঘণ্টা অনশনের পর তৎকালীন উপদেষ্টা ও বর্তমান এনসিপির আহ্বায়ক জনাব নাহিদ ইসলাম এবং তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক তথা বর্তমান এনসিপির নেতৃবৃন্দ সুস্মিতা করের সঙ্গে আলোচনায় বসে চারটি শর্তে অনশন ভঙ্গ করান।
অতঃপর, ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এবং উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সঙ্গে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়। তাঁরা ৮ দফা নিয়ে কাজ শুরু করবেন বলে আশ্বস্ত করেন এবং সাম্প্রদায়িক হামলার তালিকার ভিত্তিতে পুনর্বাসন বাবদ ক্ষতিগ্রস্তদের ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেবেন বলে জানান ও সংখ্যালঘু কমিশনের খসড়া পেশ করতে বলেন। সর্বশেষ গত ২০শে মার্চ ২০২৫ তারিখে উপদেষ্টা জনাব মাহফুজ আলমের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে নিরীহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার (যা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক) চূড়ান্ত তালিকা এবং সংখ্যালঘু কমিশনের একটি খসড়া পেশ করা হয়।
পরবর্তীতে ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আমাদের আশ্বস্ত করেন যে, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, অপরাধীদের শাস্তি প্রদানসহ ৮ দফা দাবি নিয়ে কাজ করা হবে। কিন্তু গত ৩৯৫ দিন, অর্থাৎ ১৩ মাসে (১ বছর ১ মাস), অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক ৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে আশানুরূপ কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি।
শুধু তাই নয়, দুর্গাপূজার মণ্ডপ পরিদর্শনের সময় তৎকালীন উপদেষ্টা ও বর্তমান এনসিপির আহ্বায়ক জনাব নাহিদ ইসলাম ঢাকাস্থ মিরনজিল্লা এবং যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গণকটুলী হরিজন পল্লী পরিদর্শনে যান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শেখ হাসিনা সরকারের সময় নিপীড়নের শিকার হরিজন সম্প্রদায়ের বাসস্থান সমস্যার এখনো কোনো সমাধান হয়নি। দুর্গাপূজার সময় তাঁতীবাজার পূজামণ্ডপে হামলার শিকার ৫ জনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলেও, সিসিটিভি ক্যামেরায় দৃশ্যমান থাকার পরেও হামলাকারী গ্রেপ্তার হয়নি। পাহাড়ে আদিবাসী নারী ধর্ষণের ঘটনা শুনতে শুনতে আমরা যেন এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
জাতীয় ঐক্যমত কমিশনসহ কোনো সংস্কার কমিশনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দেখা যায়নি। উপদেষ্টা পরিষদে দুজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপদেষ্টা থাকার পরেও তাদেরকে কখনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অসুবিধা নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়নি। ঐক্যমত কমিশনে কোনো রাজনৈতিক দলকেও প্রশ্ন করতে দেখা যায়নি যে, ৮% জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কীভাবে জাতীয় ঐক্য গঠিত হয়। অর্থাৎ, জুলাই-২০২৪-এর আগে হোক বা পরে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ৮% জনগোষ্ঠী এখনো শুধু রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের একটি ক্ষেত্র; তাদের অধিকার নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলকে সচেষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে না। এমন অবস্থা চলমান থাকলে, ৮% জনগোষ্ঠীকে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে ভবিষ্যতে নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্র বয়কটের সিদ্ধান্তও নিতে হতে পারে।
আবার, সম্প্রতি দেখা গেছে, জুলাই-২০২৪ আন্দোলনের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ, যারা বর্তমানে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, তারা অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘জুলাই পদযাত্রা’ করেছেন এবং বিভিন্ন জেলায় জুলাই আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তবে দুঃখজনকভাবে, তারা কোনো সংখ্যালঘু শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে দৃশ্যমান হয়নি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির প্রতিনিধিদের থেকে এমন বৈষম্যমূলক আচরণ আমাদের আরও হতাশ করেছে। একইসঙ্গে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সহিংসতার ঘটনায় জাতীয় গণমাধ্যমের নীরবতাও দুঃখজনক। বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যম যেখানে সকল শ্রেণি-পেশার জুলাই শহীদ পরিবারের চিত্র তুলে ধরেছে, সেখানে আমরা ৯ জন সংখ্যালঘু শহীদের পরিবারের কোনো সাক্ষাৎকার পাইনি।
বারবার আমরা শুনে এসেছি, আমরা যেন নিজেদের সংখ্যালঘু না ভাবি। অথচ সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার করে আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়—এই দেশে আমাদের সংখ্যা কম, আমরা সংখ্যালঘু।
দেশের এই ক্রান্তিকালে বেশকিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা চলছে। সেক্ষেত্রে দেশের গণমাধ্যমের কাছে আমাদের দাবি, আপনারা নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করুন। জাতীয় গণমাধ্যমের নীরবতা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে গুজব প্রচারের সুযোগ করে দিচ্ছে এবং দুষ্কৃতকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। একমাত্র আপনাদের সত্য প্রকাশের দৃঢ় প্রত্যয় এবং কঠোর পদক্ষেপই দুষ্কৃতকারীদের অপচেষ্টা প্রতিরোধ করতে পারবে।
আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা করছি না, কেননা বিগত ৫৩ বছরে কোনো সরকারই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। একটি দেশের অগ্রগতি ও উন্নতি তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার মাধ্যমে প্রকাশ পায়, যা সে দেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তার ওপর নির্ভরশীল। তাই আমরা আমাদের আগামী দিনের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় ৮ দফার বাস্তবায়ন চাইছি।
৮ দফা যে দেশের ৮% সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের মনের কথা, তারই জানান দিতে গত ২২শে আগস্ট ২০২৫, রোজ শুক্রবার, ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন’-এর পক্ষ থেকে “জাতীয় সংখ্যালঘু সম্মেলন-২০২৫”-এর আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে বিগত ৫৪ বছরের সাম্প্রদায়িক হামলার প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের কথা ছিল। কিন্তু সেদিনই হঠাৎ করে একটি ইনডোর প্রোগ্রামকে নিরাপত্তার অজুহাতে স্থগিত করানো হয়। পরপর তিনবার নিরাপত্তার অজুহাতে আমাদের আয়োজনে নিরাপত্তা বাহিনী বাধা প্রদান করে। সর্বশেষ, অনুমতি চেয়ে যে পত্র পাঠানো হয়, তার উত্তরে তারা দাপ্তরিকভাবে চিঠি পাঠিয়ে জানায় যে, এই সম্মেলন নিরাপত্তাজনিত কারণে করতে দেওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু, ন্যায়বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা বিশ্রাম নেব না। কারণ, গত ৫৪ বছরে এতো ‘বিভ্রান্ত সরকার’ হয়তো বাংলাদেশের মানুষ দেখেনি। রাজনৈতিক নেতাদের একটা অংশ নির্বাচন চাইছে, অন্য অংশ চাইছে সংস্কার। দেশের মানুষ পর্যন্ত দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় আছে যে, দেশ আদৌ কোন দিকে যাচ্ছে। অথচ কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকারেরই দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা নেই। না সংস্কারের আলোচনায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমস্যার কথা বলা হয়, না নির্বাচন প্রসঙ্গে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের বিষয়ে কথা বলা হয়। এমন অবস্থায়, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের “অভিবাসন ও বিদেশী আইন, ২০২৫” বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দেশত্যাগে আরও উৎসাহিত করবে বলে আমাদের আশঙ্কা।
তাই, সংস্কার হোক বা নির্বাচন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তায় ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি প্রয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে, আসন্ন দুর্গাপূজার নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দুর্গাপূজার নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশাসন থেকে ছাত্র-জনতাকে নিয়ে নিরাপত্তা দল তৈরির যে নির্দেশনা এসেছে, তা দেখে দুষ্কৃতকারীদের আড়াল করার একটি পূর্বপ্রচেষ্টার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, আমরা সকলেই জানি, বিগত বছরগুলোতে যখনই প্রতিমা ভাঙচুর বা মণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে রাজনীতি হয়েছে এবং বিনা তদন্তে নিরপরাধ মাদ্রাসার ছাত্রদের ‘শিবির ট্যাগ’ দিয়ে দোষারোপ করা হয়েছে। আমরা চাই সত্য প্রকাশিত হোক। তাই ছাত্র-জনতার সম্মিলিত নিরাপত্তা দলে মাদ্রাসার ছাত্রদের না থাকাটাই শ্রেয়। এতে করে যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তাহলে মাদ্রাসার ছাত্ররাও আমাদের সঙ্গে সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করবে।
৮ দফা বাস্তবায়ন না হলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এদেশে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারবে না। আমরা চাই, আগামীতে যে সরকারই আসুক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপদ থাকুক। বাংলাদেশ আমাদের সবার। আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার সুযোগ পেয়েছি। সেখানে প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব বৈষম্য দূর করা ও দেশকে রক্ষা করা।
আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য ৩৯৫ দিন যথেষ্ট সময় ছিল। সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহ যদি এ বিষয়ে কাজ শুরু না করে, তাহলে আমরা ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন’-এর পক্ষ থেকে আগামী ১১ই সেপ্টেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে “আমরণ গণঅনশন” কর্মসূচি শুরু করব। মনে রাখবেন, শিক্ষার্থী সমাজের হারানোর কিছু নেই এবং ৮ বিভাগের শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগের সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অভিভাবকরাও যুক্ত হবেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন চলবে। একইসঙ্গে, অনশনের প্রথম দিন সন্ধ্যায় ৮ বিভাগে একযোগে ৫৪ বছরের সাম্প্রদায়িক হামলার প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হবে। তারপর নির্বাচনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আদৌ অংশগ্রহণ করবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেবে কেবল এবং কেবলমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
সবশেষে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ ও সুশীল সমাজের উদ্দেশ্যে কথা স্পষ্ট—যদি দেশের সংস্কার কাজ করতে হয়, তবে ৮ দফার মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে; আর যদি নির্বাচন দিতে হয়, তবে সংসদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।



