ভূমি অফিসের ঘুষ: অজ্ঞতাই কি দালালদের মূল পুঁজি? যে ১০টি ভুলে ফাঁদে পড়েন সাধারণ মানুষ
অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: আমাদের অনেকের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে, ভূমি অফিসে যেকোনো সেবা নিতে গেলেই ঘুষ দিতে হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতির কারণ আমরা নিজেরাই তৈরি করি।
বেশিরভাগ মানুষের জমির কাগজপত্রে বিভিন্ন ধরনের ভুল থাকে, আর সেই ভুলগুলো সংশোধনের সুযোগ নিয়েই দালালচক্র ঘুষের ফাঁদ তৈরি করে।
জমির কাগজপত্রে সাধারণত যে ভুলগুলো দেখা যায়:
১. দলিলের ভাষাগত ভুল: দলিল লেখকের অসাবধানতায় শব্দ বা বাক্যের ভুল হলে তা পরবর্তীতে সংশোধনের প্রয়োজন হয়, যা জটিলতা বৃদ্ধি করে।
২. নামের বানানে ভুল: দলিলের মালিক, তার পিতা বা দাদার নামের বানান ভুল থাকলে কিংবা ভিন্ন ভিন্ন দলিলে ভিন্ন নাম থাকলে তা নামজারি বা খারিজের সময় বড় সমস্যা তৈরি করে।
৩. ঠিকানার ভুল: মৌজা, গ্রাম, ইউনিয়ন বা থানার নাম ভুল লেখা হলে জমি শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৪. জমির পরিমাণে ভুল: জমির পরিমাণ (অংশ) স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলে বা ভুলভাবে লেখা হলে বিরোধ সৃষ্টি হয়। যেমন: ৫০ শতকের স্থলে ভুলবশত ৫ শতক লেখা হলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে।
৫. দাগ নম্বর ভুল: দলিলে জমির সঠিক দাগ নম্বর উল্লেখ না থাকলে এমনও হতে পারে যে, আপনি নিজের অজান্তেই অন্যের জমির দলিল বহন করছেন।
৬. চৌহদ্দির ভুল: জমির চারপাশের সীমানা (চৌহদ্দি) বর্ণনায় ভুল থাকলে জমির প্রকৃত মালিকানা নিয়েই সন্দেহ তৈরি হতে পারে।
৭. বণ্টননামা না থাকা: উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ভাইবোনদের মধ্যে যথাযথ বণ্টননামা দলিল না থাকলে মালিকানা নিয়ে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হয়।
৮. বায়না বা রেজিস্ট্রিকৃত ক্রয় দলিল না থাকা: মৌখিক কেনাবেচা বা শুধু বায়নাপত্র আইনত মালিকানার চূড়ান্ত প্রমাণ নয়। রেজিস্ট্রিকৃত দলিল ছাড়া মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
৯. হালনাগাদ খতিয়ান না থাকা: দলিল থাকা সত্ত্বেও যদি খতিয়ান হালনাগাদ (নামজারি) না করা হয়, তবে সরকারি রেকর্ডে আপনি জমির মালিক হিসেবে গণ্য হবেন না।
১০. হালনাগাদ দাখিলা না থাকা: জমির ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা নিয়মিত পরিশোধ না করলে মালিকানা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে এবং সরকার আইন অনুযায়ী সেই জমি খাস হিসেবে অধিগ্রহণ করতে পারে।
এই ভুলগুলো কীভাবে ঘুষের কারণ হয়?
যখন ত্রুটিপূর্ণ বা অসম্পূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে ভূমি অফিসে আবেদন জমা দেওয়া হয়, তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আইন অনুযায়ী সেটি সরাসরি গ্রহণ করতে পারেন না। এই সুযোগে আবেদনকারীকে দ্রুত কাজ করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে দালালরা টাকার বিনিময়ে সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দেয়। এভাবেই পদ্ধতিগত জটিলতা এবং সেবাগ্রহীতার অজ্ঞতাকে পুঁজি করে ঘুষের লেনদেন তৈরি হয়।
সমাধান ও প্রতিকার:
- নির্ভুল দলিল সম্পাদন: দলিল সম্পাদনের সময় অভিজ্ঞ দলিল লেখক নির্বাচন করুন এবং প্রতিটি শব্দ ও বাক্য মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।
- সকল কাগজপত্র মিলিয়ে দেখা: ক্রয় বা মালিকানা গ্রহণের পূর্বে জমির দলিল, খতিয়ান, নকশা এবং দাখিলা একসঙ্গে মিলিয়ে যাচাই করুন।
- দ্রুত ভুল সংশোধন: দলিলে নাম, ঠিকানা বা দাগ নম্বরে কোনো ভুল ধরা পড়লে দ্রুততম সময়ে তা সংশোধন (হেবা বা ভ্রম সংশোধন দলিল) করে নিন।
- বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ: নিজে সম্পূর্ণ বুঝতে না পারলে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে সকল কাগজপত্র যাচাই করিয়ে নিন।
- প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি: ভূমি অফিসে যাওয়ার আগে নামজারি, কর পরিশোধ, খতিয়ান সংগ্রহসহ সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত রাখুন।
মনে রাখা প্রয়োজন, ভূমি অফিসের সেবা পেতে ঘুষ অপরিহার্য নয়। জমির কাগজপত্র সঠিক ও হালনাগাদ থাকলে এবং নাগরিক হিসেবে আপনি সচেতন হলে দালালের সাহায্য ছাড়াই আইনি প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ করা সম্ভব, যা ঘুষের প্রবণতাও কমিয়ে আনবে।



