দেশপরিবেশবাংলাদেশবিশ্লেষণরাষ্ট্রনীতিসংগৃহীত সংবাদ

জমি কেনার চূড়ান্ত চেকলিস্ট: যে ২০টি বিষয় না দেখলে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ

দলিল যাচাই থেকে শুরু করে সরেজমিনে দখল পর্যবেক্ষণ—জমি কেনার আগে এই বিষয়গুলো নিশ্চিত না করলে আপনার সারাজীবনের সঞ্চয় পানিতে যেতে পারে। জেনে নিন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ।

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: বাড়ি করার স্বপ্ন বা লাভজনক বিনিয়োগের আশায় জমি কেনা অনেকেরই জীবনের বড় একটি লক্ষ্য। কিন্তু আইনি জটিলতা এবং প্রতারণার ফাঁদে পড়ে এই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে মুহূর্তেই। সামান্য একটি ভুলের কারণে হারাতে হতে পারে কষ্টার্জিত অর্থ, এমনকি জড়িয়ে পড়তে হতে পারে দীর্ঘমেয়াদী মামলায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি কেনার আগে কিছু অপরিহার্য বিষয় যাচাই করে নিলে প্রতারণার ঝুঁকি প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। এই প্রতিবেদনে আমরা জমি কেনার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ চেকলিস্ট তুলে ধরছি, যা আপনাকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।

প্রথম ধাপ: আইনি কাগজপত্র যাচাই

জমির মালিকানার ভিত্তি হলো এর আইনি কাগজপত্র। এই নথিগুলো নির্ভুল না থাকলে আপনার মালিকানাই হুমকির মুখে পড়বে।

  • ১. দলিলের সত্যতা: দলিলটি আসল কি না, তা যাচাইয়ের জন্য সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে এর রেকর্ড পরীক্ষা করুন।
  • ২. খতিয়ান যাচাই: সিএস, এসএ, আরএস ও বিএস খতিয়ানগুলো ভালোভাবে দেখে নিশ্চিত হোন যে, জমির মালিকানা বিক্রেতার নামেই রয়েছে।
  • ৩. নামজারি (মিউটেশন): বিক্রেতার নামে জমির নামজারি বা মিউটেশন করা না থাকলে সেই জমি কেনা থেকে বিরত থাকুন। এটি হালনাগাদ মালিকানার প্রমাণ।
  • ৪. দাগ নম্বরের মিল: দলিল, খতিয়ান এবং মৌজা ম্যাপ—এই তিনটি নথিতে জমির দাগ নম্বর একই আছে কি না, তা নিশ্চিত করুন।
  • ৫. মালিকানার ইতিহাস: জমির পূর্ববর্তী মালিক কারা ছিলেন এবং কীভাবে মালিকানা হস্তান্তর হয়েছে, তা খতিয়ে দেখুন।
  • ৬. খাজনার রশিদ: জমির ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা হালনাগাদ আছে কি না, তার দাখিলা পরীক্ষা করুন। বকেয়া থাকলে বড় ধরনের জরিমানা হতে পারে।

দ্বিতীয় ধাপ: বাস্তব অবস্থা ও দখলদারিত্ব পর্যবেক্ষণ

কাগজপত্র ঠিক থাকলেও জমির বাস্তব অবস্থা যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি।

  • ৭. সরেজমিনে দখল: জমিতে বিক্রেতার প্রকৃত দখল আছে কি না, তা নিজে গিয়ে দেখুন। অনেক সময় কাগজে এক মালিক, আর দখলে অন্য কেউ থাকে।
  • ৮. সঠিক পরিমাপ: দক্ষ সার্ভেয়ার দিয়ে জমি মেপে এর পরিমাণ ও সীমানা (চৌহদ্দি) নিশ্চিত করুন।
  • ৯. প্রবেশপথ: জমিতে যাতায়াতের জন্য উপযুক্ত রাস্তা আছে কি না, তা সরেজমিনে এবং নকশায় মিলিয়ে দেখুন। রাস্তা না থাকলে ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়বেন।
  • ১০. ভৌগোলিক অবস্থা: জমিটি নিচু, জলাবদ্ধ বা বন্যাপ্রবণ কি না, তা স্থানীয়দের কাছ থেকে জেনে নিন।
  • ১১. আশপাশের পরিবেশ: জমির প্রতিবেশী কারা এবং তাদের সঙ্গে কোনো সীমানা বিরোধ আছে কি না, তা খোঁজ নিন।

তৃতীয় ধাপ: সরকারি ও আইনি জটিলতা পরীক্ষা

অনেক সময় আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু ঠিক মনে হলেও পেছনে লুকিয়ে থাকে মারাত্মক আইনি ঝুঁকি।

  • ১২. মামলা-মোকদ্দমা: জমিটি নিয়ে আদালতে কোনো মামলা চলছে কি না, তা খোঁজ নিন।
  • ১৩. ঋণ বা বন্ধক: জমিটি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া হয়েছে কি না, তা যাচাই করুন।
  • ১৪. ওয়ারিশদের সম্মতি: উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমি হলে সকল ওয়ারিশের সম্মতিপত্র বা বণ্টননামা আছে কি না, তা নিশ্চিত করুন।
  • ১৫. সরকারি অধিগ্রহণ: জমিটি কোনো সরকারি প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে বা হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে কি না, তা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জেনে নিন।
  • ১৬. খাস বা অর্পিত সম্পত্তি: প্রস্তাবিত জমিটি খাস, ভিপি বা পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত কি না, তা ভূমি অফিস থেকে যাচাই করুন।

চতুর্থ ধাপ: চূড়ান্ত পদক্ষেপ ও সতর্কতা

সবকিছু যাচাই করার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকুন।

  • ১৭. ভূমি ব্যবহার: জমিটি আবাসিক, বাণিজ্যিক না কি কৃষি—কোন কাজে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত, তা জেনে নিন।
  • ১৮. নকশার সঙ্গে তুলনা: সরকারি নকশার সঙ্গে জমির বাস্তব অবস্থার মিল আছে কি না, তা মিলিয়ে দেখুন।
  • ১৯. বায়না চুক্তিপত্র: টাকা লেনদেনের আগে একটি বায়না চুক্তিপত্রে সমস্ত শর্ত (যেমন: মূল্য, পরিশোধের সময়সীমা) স্পষ্টভাবে লিখে নিন।
  • ২০. বিশেষজ্ঞের পরামর্শ: পুরো প্রক্রিয়ায় একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী বা ভূমি বিশেষজ্ঞকে সঙ্গে রাখুন। তার পরামর্শ আপনাকে বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে।

সর্বোপরি, জমি কেনার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তাড়াহুড়ো না করে, সময় নিয়ে প্রতিটি বিষয় যাচাই করুন। আপনার সচেতনতাই আপনাকে সুরক্ষিত রাখবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button