Uncategorized

দলিল রেজিস্ট্রি হয়, কিন্তু যাচাই হয় না: সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের অবহেলায় সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ

আইন অনুযায়ী মালিকানা যাচাই বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে তা না হওয়ায় বাড়ছে জাল-জালিয়াতি, মামলা ও ভূমি দখল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জবাবদিহিই পারে এই সংকট থেকে মুক্তি দিতে।

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: আপনি হয়তো জীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে এক খণ্ড জমি কিনলেন। নামজারি, খতিয়ান সব ঠিক আছে ভেবে দলিলও রেজিস্ট্রি করলেন। কিন্তু কিছুদিন পর জানতে পারলেন, একই জমি আরও দুজনের কাছে বিক্রি করা হয়েছে অথবা বিক্রেতাই জমির আসল মালিক ছিলেন না। এমন ঘটনা এখন দেশজুড়ে হাজারো মানুষের কান্নার কারণ।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ভয়াবহ প্রতারণার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দলিল নিবন্ধনের সময় মালিকানার সত্যতা যাচাই না করা। আইনত বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে এই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ না করায় ভূমি ব্যবস্থাপনায় তৈরি হয়েছে এক নৈরাজ্যের পরিস্থিতি।

আইনের নির্দেশনা এক, বাস্তবতা ভিন্ন

Registration Act, 1908 এবং Transfer of Property Act, 1882 অনুযায়ী, একজন সাব-রেজিস্ট্রার শুধু কাগজে স্বাক্ষর দেখে দলিল রেজিস্ট্রি করতে পারেন না। তার দায়িত্ব হলো—দলিলের দাতা বা বিক্রেতাই জমির প্রকৃত মালিক কি না, জমির খতিয়ান, দাগ নম্বর এবং নামজারি সঠিক আছে কি না, তা যাচাই করা।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সাব-রেজিস্ট্রাররা কেবল দাতা-গ্রহীতার উপস্থিতি এবং কাগজে তথ্যের মিল দেখেই দলিল রেজিস্ট্রি করে দেন। দলিল লেখকের তৈরি করা তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই সম্পন্ন হয় পুরো প্রক্রিয়া। ফলে তৈরি হয় জালিয়াতির এক বিশাল সুযোগ।

অবহেলার ভয়াবহ परिणाम: বাড়ছে অপরাধ ও মামলা

এই পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে সমাজে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • একই জমি বারবার বিক্রি: সবচেয়ে সাধারণ প্রতারণাগুলোর মধ্যে এটি একটি। যাচাই না হওয়ায় প্রতারকরা একই জমি একাধিকবার বিক্রি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
  • জাল দলিলের দৌরাত্ম্য: ভুয়া মালিক সেজে বা জাল কাগজপত্র তৈরি করে জমি বিক্রির ঘটনা অহরহ ঘটছে।
  • মামলার পাহাড়: একটি ভুল নিবন্ধনের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে একাধিক মামলা, যা দেশের আদালতগুলোতে মামলার জট আরও বাড়িয়ে তুলছে।
  • ভূমি দখল ও সংঘাত: জাল দলিলকে ভিত্তি করে পেশিশক্তির জোরে জমি দখল এবং এর জের ধরে সহিংসতা, এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, জমি কিনেও দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে তাদের। সারাজীবনের উপার্জন দিয়ে কেনা সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে অনেকেই হচ্ছেন নিঃস্ব।

বিশেষজ্ঞদের মতে সমাধান কী?

ভূমি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

১. পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল যাচাই: দলিল নিবন্ধনের আগেই ভূমি অফিসের সার্ভারের সঙ্গে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সার্ভারকে যুক্ত করতে হবে। এর মাধ্যমে নিবন্ধনের মুহূর্তে অনলাইনেই জমির মালিকানা, দাগ, খতিয়ান যাচাই বাধ্যতামূলক করতে হবে।

২. জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ: কোনো জমি নিয়ে জালিয়াতি প্রমাণিত হলে এবং সেখানে সাব-রেজিস্ট্রারের অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৩. জনসচেতনতা: জমি কেনার আগে ক্রেতাকে নিজের দায়িত্বেই আইনজীবী বা বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে সকল কাগজপত্র যাচাই করতে হবে। শুধু দলিল লেখকের ওপর নির্ভর করা যাবে না।

৪. দুর্নীতি প্রতিরোধ: ঘুষের বিনিময়ে যাচাই ছাড়া দলিল নিবন্ধনের যে অভিযোগ প্রায়ই ওঠে, তা তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা না এলে সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কঠিন। একটি জমির দলিল নিছক একটি কাগজ নয়, এটি একটি পরিবারের স্বপ্ন ও নিরাপত্তার প্রতীক। সেই প্রতীককে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button