আইন ও বিচারদেশবাংলাদেশসংগৃহীত সংবাদ

সম্পত্তির বিবাদ এড়াতে বন্টননামা দলিল: জেনে নিন নিয়মকানুন ও খরচের খুঁটিনাটি

বিশেষ প্রতিবেদন: বাংলাদেশে জমিজমা সংক্রান্ত মামলার একটি বড় অংশই ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধের ফল। এই ধরনের দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল মামলা থেকে বাঁচতে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ‘বন্টননামা’ বা ‘বাটোয়ারা দলিল’। ওয়ারিশসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির অংশীদারদের মধ্যে ভবিষ্যতে যেন কোনো বিবাদ সৃষ্টি না হয়, সেজন্য শুরুতেই এই দলিলটি রেজিস্ট্রি করে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

কেন বন্টননামা দলিল এত গুরুত্বপূর্ণ?

একটি রেজিস্ট্রিকৃত বন্টননামা দলিল নানা ক্ষেত্রে সুরক্ষা প্রদান করে। এর প্রধান সুবিধাগুলো হলো:

  • লিখিত প্রমাণ: এটি অংশীদারদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টনের একটি আইনগত ও চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। ফলে কোনো পক্ষই ভবিষ্যতে এই বন্টন অস্বীকার করতে পারে না।
  • নামজারি (Mutation): ওয়ারিশি সম্পত্তির নামজারি করার জন্য বন্টননামা দলিল একটি অপরিহার্য নথি।
  • জমি বিক্রয়: নিজের অংশের জমি বিক্রি করতে গেলে ক্রেতার আস্থা অর্জন এবং আইনি স্বচ্ছতার জন্য এই দলিলের প্রয়োজন হয়।
  • রেকর্ড হালনাগাদ: ভূমি জরিপের সময় নিজ নামে জমির রেকর্ড করাতে বন্টননামা দলিল সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
  • ব্যাংক ঋণ: সম্পত্তির বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চাইলে এই দলিল থাকা আবশ্যক।
  • মামলা প্রতিরোধ: সঠিকভাবে বন্টননামা করা থাকলে অংশীদারদের মধ্যে futuro মামলা-মোকদ্দমার আশঙ্কা প্রায় থাকেই না।

বন্টননামা দলিল করতে কী কী প্রয়োজন?

দলিল সম্পাদনের জন্য কিছু আবশ্যকীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হয়। সেগুলো হলো:

  1. মৃত্যু সনদ: যে ব্যক্তির সম্পত্তি বন্টন করা হবে, তার মৃত্যু সনদ।
  2. ওয়ারিশ সনদ: মৃত ব্যক্তির বৈধ উত্তরাধিকারী কারা, তা প্রমাণের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ (যেমন: ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন) কর্তৃক প্রদত্ত ওয়ারিশ সনদ।
  3. মালিকানার দলিল: বন্টনযোগ্য সম্পত্তির মূল দলিল বা মালিকানার প্রমাণপত্র।
  4. ওয়ারিশদের সম্মতি: সকল ওয়ারিশ বা অংশীদারের দলিলে উল্লেখিত বন্টনে সম্মতি থাকতে হবে।

দলিল সম্পাদনের প্রক্রিয়া

আপোষের ভিত্তিতে একটি বন্টননামা দলিল সম্পন্ন করার ধাপগুলো নিম্নরূপ:

  1. আইনজীবী বা দলিল লেখকের শরণাপন্ন হওয়া: প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী বা দলিল লেখকের কাছে যেতে হবে।
  2. দলিলের খসড়া প্রস্তুত: আইনজীবী বা দলিল লেখক সম্পত্তির মূল দলিল যাচাই করে সকল পক্ষের সম্মতিক্রমে বন্টননামার একটি খসড়া প্রস্তুত করবেন।
  3. সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থাপন: খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর সকল অংশীদারকে নির্ধারিত সরকারি ফি সহ সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থিত হতে হবে।
  4. স্বাক্ষর ও রেজিস্ট্রেশন: সাব-রেজিস্ট্রারের সামনে সকল পক্ষ রেজিস্ট্রি ভলিউমে স্বাক্ষর করবেন। এরপর সাব-রেজিস্ট্রার দলিলটি আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রি করে নেবেন। প্রক্রিয়া শেষে দলিলের একটি সার্টিফায়েড কপি (নকল) সংগ্রহ করে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।

বন্টননামা দলিলের রেজিস্ট্রেশন ও অন্যান্য খরচ

বন্টননামা দলিল রেজিস্ট্রেশনের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি ও শুল্ক প্রদান করতে হয়। খরচের একটি বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো:

  • রেজিস্ট্রেশন ফি: (বৃহত্তম এক পক্ষের অংশের মূল্য বাদ দিয়ে বাকি অংশের মোট মূল্যের উপর):
    • মূল্য ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে: ৫০০ টাকা।
    • মূল্য ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে: ৭০০ টাকা।
    • মূল্য ৩০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে: ১,২০০ টাকা।
    • মূল্য ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে: ১,৮০০ টাকা।
    • মূল্য ৫০ লক্ষ টাকার ঊর্ধ্বে হলে: ২,০০০ টাকা।
      (এই ফি পে-অর্ডারের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের নির্দিষ্ট কোডে জমা দিতে হয়।)
  • স্টাম্প শুল্ক: ৫০ টাকা (স্টাম্প আইন, ১৮৯৯ অনুযায়ী)।

অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ:

  • হলফনামা: ২০০ টাকার স্টাম্পে প্রিন্ট করা হলফনামা।
  • ই-ফি: ১০০ টাকা।
  • এন-ফি (প্রতি ৩০০ শব্দের পৃষ্ঠার জন্য): বাংলায় ১৬ টাকা, ইংরেজিতে ২৪ টাকা।
  • এনএন-ফি (নকলনবিশদের পারিশ্রমিক): বাংলায় প্রতি পৃষ্ঠার জন্য ২৪ টাকা, ইংরেজিতে ৩৬ টাকা (এই ফি নগদে অফিসে জমা দিতে হয়)।
  • কোর্ট ফি: সম্পত্তি হস্তান্তর নোটিশের আবেদনে ১০ টাকার কোর্ট ফি।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ওয়ারিশসূত্রে প্রাপ্ত স্থাবর সম্পত্তি ছাড়া অন্য কোনোভাবে অর্জিত সম্পত্তির বন্টননামার ক্ষেত্রে উৎস কর প্রযোজ্য হবে। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী, রেকর্ডীয় মালিকের মৃত্যুর পর তার ওয়ারিশদের জন্য বন্টননামা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button