ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে দুই ভাইয়ের সরকারী চাকুরী, মূল পরিবার মানবেতর জীবনে

রাজবাড়ীতে সংঘবদ্ধ জালিয়াতির অভিযোগ, তদন্তের দাবি
মোঃ রফিকুল ইসলাম: রাজবাড়ীতে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার ভূয়া নাতি পরিচয়ে দুই ভাইয়ের সরকারী চাকুরী লাভের চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটার এই সুবিধা হাতিয়ে নেওয়া হলেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার প্রথম স্ত্রী ও কন্যা সরকারী অনুদান থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই ঘটনায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে, যারা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পরিচয় জালিয়াতি থেকে শুরু করে ভুয়া কাবিননামা ও প্রত্যয়নপত্র তৈরিতে সহায়তা করেছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ লোকমান শেখ (মুক্তিযোদ্ধা নং-০১৮২০০০০২৫৭) ২০২২ সালের ১২ই মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রথম স্ত্রী হাজেরা বেগম ও একমাত্র কন্যা ফিরোজা আক্তার বর্তমানে কালুখালী উপজেলায় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। ফিরোজা দিনমজুরের কাজ করে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে সংসার চালান। অথচ লোকমান শেখের দ্বিতীয় স্ত্রীর দুই পুত্র থাকা সত্ত্বেও ফাতেমা বেগম নামেсторон এক নারী নিজেকে তার ‘হারিয়ে যাওয়া’ কন্যা দাবি করে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সকল সুবিধা ভোগ করছেন।
যেভাবে ঘটেছে জালিয়াতি:
অভিযোগ অনুযায়ী, বসন্তপুর ইউনিয়নের উদয়পুর গ্রামের বাসিন্দা আফসার সরদারের কন্যা ফাতেমা বেগম ২০১৭ সালে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে একটি চক্রের মাধ্যমে নিজের পিতার নাম পরিবর্তন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান শেখের কন্যা হিসেবে পরিচয়পত্র তৈরি করেন। এই ভূয়া পরিচয়ের ভিত্তিতেই তার দুই পুত্র—রাসেল শেখ ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পুলিশে এবং রিংকু শেখ ২০২৪ সালে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে সরকারী চাকুরী লাভ করেন।
কাগজপত্রে অসঙ্গতি ও জালিয়াতির প্রমাণ:
এই জালিয়াতির পেছনে বেশ কিছু গুরুতর অসঙ্গতি সামনে এসেছে:
- বয়সের গরমিল: ফাতেমা বেগমের জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) তার জন্ম তারিখ ০৬/০৯/১৯৭২ এবং তার মা আতকজান বিবির জন্ম সাল ১৯৬৭ উল্লেখ রয়েছে। সে হিসেবে মা ও মেয়ের বয়সের পার্থক্য মাত্র ৫ বছর, যা জৈবিকভাবে অসম্ভব।
- ভূয়া কাবিননামা: ফাতেমা বেগমের ১৯৮۷ সালের বিবাহের কাবিননামা তৈরি করেছেন বসন্তপুর ইউনিয়নের ম্যারিজ রেজিস্ট্রার দেওয়ান মোঃ বায়েজিদ সুলতান (বকুল), যিনি সরকারীভাবে লাইসেন্স পেয়েছেন ২০০২ সালে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি তার প্রয়াত পিতার পুরনো রেজিস্টার বই ব্যবহার করে এই জালিয়াতি করেছেন।
- ত্রুটিপূর্ণ প্রত্যয়নপত্র: বসন্তপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ জাকির হোসেন সরদার কর্তৃক প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্রে কোনো দাপ্তরিক স্মারক নম্বর ব্যবহার করা হয়নি, যা এর বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্য:
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ফাতেমা বেগম দাবি করেন, তিনি শিশুকালে হারিয়ে গিয়েছিলেন এবং প্রায় ৫৫ বছর পর তার পিতা লোকমান শেখকে খুঁজে পান। তার দাবি, তার পুত্রের চাকুরীর বিষয়ে এর আগে পুলিশ তদন্ত করে কোনো অনিয়ম পায়নি।
অন্যদিকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান শেখের প্রকৃত কন্যা ফিরোজা আক্তার নিশ্চিত করেছেন যে, ফাতেমা বেগম নামে তাদের কোনো বোন নেই এবং এটি একটি পরিকল্পিত প্রতারণা।
রাজবাড়ীর সদ্য বিদায়ী মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রেজাউল করিম লাল এই ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারী চাকুরী নেওয়া একটি গর্হিত অপরাধ। এর ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।” তিনি জেলার সকল মুক্তিযোদ্ধার সনদ যাচাই করে ভূয়া সনদধারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের নিকট অনুরোধ জানান।
অভিজ্ঞ মহল মনে করছে, ফাতেমা বেগম ও তার ভাইবোনদের ডিএনএ পরীক্ষা করা হলেই পুরো রহস্যের জট খুলবে। এই সংঘবদ্ধ জালিয়াতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সহ সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরগুলোর দ্রুত তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।



