অপরাধআইন, ও বিচারআন্তর্জাতিকদেশবিশ্লেষণসংগৃহীত সংবাদ

এক কিশোরীর জন্য ষড়যন্ত্র, পাথর ছুড়ে সুরাইয়ার মৃত্যুদণ্ড

অনলাইন ডেস্ক: ইরানের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বধূ সুরাইয়া। স্বামী, দুই পুত্র ও দুই কন্যাকে নিয়ে ছিল তার সংসার। কিন্তু স্বামীর লালসার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তার সাজানো জীবন। চৌদ্দ বছর বয়সী এক কিশোরীকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার লোভে স্বামী যে ষড়যন্ত্রের জাল বোনে, তাতে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয় সুরাইয়াকে।

Courtesy of MPower Pictures

ঘটনার সূত্রপাত, যখন সুরাইয়ার স্বামী এক কিশোরীকে বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিশোরীর অসুস্থ বাবার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহনের বিনিময়ে সে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রথম স্ত্রী সুরাইয়া এবং সংসারের বাড়তি খরচের চিন্তা। এই বাধা দূর করতে এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করে সে।

গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে পরকীয়ার মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে দেয় সুরাইয়ার স্বামী। এরপর হুমকি দিয়ে জোগাড় করা হয় ভুয়া সাক্ষী। ফলে গ্রামের তথাকথিত বিচারে সুরাইয়ার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং তাকে পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় দেওয়া হয়।

সেই মৃত্যুদণ্ড ছিল বর্বরতার চূড়ান্ত নিদর্শন। গ্রামের রাস্তায় গর্ত খুঁড়ে হাত-পা বেঁধে সুরাইয়াকে কোমর পর্যন্ত পুঁতে ফেলা হয়। এরপর উপস্থিত জনতার ছোড়া পাথরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে তার শরীর। মর্মান্তিকভাবে, প্রথম পাথরটি ছুড়তে বাধ্য করা হয় তার বাবাকেই। এমনকি নিজের দুই সন্তানকেও জোর করে শামিল করা হয় মায়ের দিকে পাথর ছোড়ার এই নারকীয় উল্লাসে।

অবিরাম পাথর নিক্ষেপের পর একসময় সুরাইয়ার দেহ নিস্তেজ হয়ে আসে। তখন তার স্বামী এগিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে সে জীবিত আছে কিনা। কিন্তু তখনও শ্বাস চলছিল সুরাইয়ার। এটা বুঝতে পেরেই উপস্থিত জনতা পুনরায় তার উপর পাথর ছুড়তে শুরু করে। এভাবেই নিশ্চিত করা হয় তার মৃত্যু।

এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন ইরানি লেখক ও সাংবাদিক ফ্রেদৌনি সাহেবজাম। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত তার “দ্য স্টোনিং অফ সুরাইয়া এম.” বইটি একটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লেখা। প্রকাশের পরপরই ইরান সরকার বইটি নিষিদ্ধ করলেও এটি আন্তর্জাতিক বেস্টসেলারের খ্যাতি লাভ করে। ২০০৮ সালে এই বইয়ের কাহিনি নিয়ে একই নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।

ভাগ্যের পরিহাস, সুরাইয়ার মৃত্যুর ঠিক পরদিনই সেই কিশোরীর অসুস্থ বাবাও মারা যান। ফলে কিশোরীকে বিয়ে করার যে অদম্য ইচ্ছা থেকে এই নৃশংসতার জন্ম, তা আর পূরণ হয়নি সুরাইয়ার স্বামীর।

সুরাইয়ার সেই মলিন চোখজোড়া হয়তো স্মরণ করিয়ে দেয় তুরস্কের এক কবির অমর পঙক্তিমালা:

“আমি তোমাকে লুকিয়ে রাখবো, বিশ্বাস করো,
আমার লেখায়, আমার আঁকায়,
আমার গানে, আমার কথায়।
তুমি থাকবে, কিন্তু কেউ জানবে না,
এবং কেউ তোমাকে দেখতে পাবে না,
কেবল আমার চোখেই তুমি বেঁচে থাকবে।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button