চটকদার সাফল্যের ফাঁদ: চাকরি ছেড়ে লাখপতি হওয়ার গল্পের পেছনের বাস্তবতা
“বেগুনের খেত করে মাসে ২ লাখ টাকা ইনকাম” বা “চাকরি ছেড়ে গোবর ছেনে কোটিপতি”—এমন শিরোনাম এখন প্রায়ই চোখে পড়ে। তরুণদের অনেকেই এসব গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্রুত সাফল্য লাভের স্বপ্নে বিভোর হন।
তরুণদের জন্য পরামর্শ, এই ফাঁদে পা দেবেন না। আমাদেরই বয়সী একজনের বাস্তব অভিজ্ঞতা—ভালো বেতনের চাকরি ছেড়ে এমন দ্রুত উপার্জনের নেশায় পড়েছিলেন, এখন তিনি চরম হতাশায় ভুগছেন।
আপনি যে কাজই করুন না কেন, তার সম্প্রসারণযোগ্যতা (expandability) থাকা আবশ্যক। উদাহরণস্বরূপ, একজন রিকশাচালক হয়তো একজন নতুন চাকরিজীবীর চেয়ে বেশি আয় করেন। রিকশাওয়ালারা মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন, যেখানে চাকরিতে নতুন একজনের বেতন মাত্র ১৫ হাজার—আপনাকে শুধু এটুকুই বলা হবে।
এবার পরের হিসাবটা ভাবুন! ওই রিকশাচালক যদি তার আয় দ্বিগুণ বা সামান্য বাড়াতে চান, তাহলে তাকে রিকশা চালানোর সময় বাড়াতে হবে। আয় দ্বিগুণ করতে হলে তাকে ১০ ঘণ্টার জায়গায় ২০ ঘণ্টা রিকশা চালাতে হবে, যা শারীরিকভাবে প্রায় অসম্ভব। এর বাইরে রোদ-বৃষ্টির প্রতিবন্ধকতা তো আছেই, ছুটির দিনে কাজে না গেলে কোনো আয়ও নেই।
কিন্তু একটি প্রাথমিক স্তরের চাকরিতে ৪-৫ বছরের মধ্যে কর্মঘণ্টা না বাড়িয়েই বেতন দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক।
আপনি যে কাজটি করতে চান, সেটি প্রথমে আপনার ভালো লাগতে হবে। ফেসবুকের কোনো চটকদার লেখা পড়ে আপনি বাজারে চা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলেন, কারণ এতে চাকরির চেয়ে দ্বিগুণ আয়। কিন্তু ভেবে দেখুন, আগামী ৩০ বছর আপনি চায়ের কাপ-পিরিচ ও চুলা নিয়ে এই কাজটি করতে পারবেন কি না।
এর সঙ্গে জীবনযাত্রার একটি বিষয়ও জড়িত। আপনার যখন আয় কম ছিল, তখন হয়তো বাইক চালাতেন। ভবিষ্যতে টাকা হলে গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু আপনি যদি ঝালমুড়ি বিক্রি করেন, তাহলে কি গাড়ি চালিয়ে সেই কাজ করতে যাবেন? একজন চাকরিজীবী বা উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি একটি নির্দিষ্ট জীবনধারা ও সামাজিক নেটওয়ার্ক পাবেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ধরুন, আপনি একটি স্টেশনারি কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে চাকরি করেন। কাজের সুবাদে আপনাকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা বড় প্রতিষ্ঠানে ব্যবসায়িক চুক্তি করতে যেতে হবে। এতে বহু উচ্চ-দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে আপনার পরিচিতি ও যোগাযোগ গড়ে উঠবে।
অন্যদিকে, শুধু টাকার লোভে আপনি যদি রাস্তায় বাদাম বিক্রি শুরু করেন, আপনার নেটওয়ার্ক সীমাবদ্ধ থাকবে পাশের ফুচকাওয়ালা বা আইসক্রিম বিক্রেতার মধ্যে। সেই ফুচকাওয়ালার একমাত্র চিন্তা হলো, কতক্ষণে তার সব মাল বিক্রি করে বাড়ি ফিরবেন। আপনার মতো বড় হওয়ার স্বপ্ন বা দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছা তার নাও থাকতে পারে।
মনে রাখবেন, “Your network is your net worth” (আপনার পরিচিতির পরিধিই আপনার সম্পদ)। তাছাড়া, গণমাধ্যমে যেভাবে প্রচার করা হয়, বাস্তবে ওই সব পেশায় তত বেশি আয় হয় না। “চাকরি ছেড়ে বেগুন চাষে লাখপতি” শিরোনামের খবরের ভেতরে হয়তো দেখা যায়, তিনি বছরে সর্বসাকুল্যে ৩ লাখ টাকা আয় করেছেন। অর্থাৎ, তার মাসিক আয় মাত্র ২৫ হাজার টাকা, যা নিয়েও সংবাদ তৈরি হয়!
তাই এসব ভুয়া অনুপ্রেরণার ফাঁদে পড়বেন না। গণমাধ্যমগুলো প্রায়ই নিজেদের প্রচারের স্বার্থে এমন সংবাদ করে। গত পাঁচ বছরে আইফোন হাতে চানাচুরওয়ালা বা ডিএসএলআর ক্যামেরা কাঁধে চটপটি বিক্রেতার মতো অনেক ছবিই দেখেছেন। প্রশ্ন হলো, তারা এখন কোথায়? তারা কি এখনও রাস্তায় একই রকম আয় করছেন? যদি না করেন, তাহলে এগুলোকে কীভাবে নির্ভরযোগ্য পেশা বলা যায়?
কোনো কাজই ছোট নয়, কিন্তু সব কাজ আপনার জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে। হয়তো আপনার কাছে একটি চমৎকার পরিকল্পনা আছে, কিন্তু পঞ্চাশ হাজার টাকার অভাবে আপনি এগোতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে, মাছ বিক্রি করে বা চানাচুর বেচে সেই টাকা জোগাড় করা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হতে পারে। কিন্তু যখন এসব পেশাকে একটি স্থিতিশীল চাকরির বিকল্প হিসেবে দেখানো হয়, তা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়।



