সুস্থ হার্টের জন্য বছরে একবার লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করুন

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: হৃদরোগসহ নানা জটিল রোগের ঝুঁকি এড়াতে বছরে অন্তত একবার লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরিমাপ করা হয়, যা প্রাথমিক অবস্থাতেই সম্ভাব্য বিপদ সনাক্ত করতে সাহায্য করে।
লিপিড প্রোফাইল টেস্ট কী?
সহজ কথায়, এটি হলো রক্তের চর্বি বা কোলেস্টেরল পরিমাপের পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে প্রধানত তিন ধরনের কোলেস্টেরল পরিমাপ করা হয়:
- এইচডিএল (High-Density Lipoprotein): একে “ভালো কোলেস্টেরল” বলা হয়। এর কাজ হলো রক্তনালী থেকে ক্ষতিকর চর্বি যকৃতে (লিভারে) ফিরিয়ে আনা। তাই রক্তে এর মাত্রা বেশি থাকা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
- এলডিএল (Low-Density Lipoprotein): এটি “খারাপ কোলেস্টেরল” নামে পরিচিত। এর মাত্রা বেড়ে গেলে তা ধমনীর দেয়ালে জমে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে, যা থেকে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
- ট্রাইগ্লিসারাইড (Triglycerides): এটি রক্তে থাকা আরেক প্রকার চর্বি। शरीरে অব্যবহৃত অতিরিক্ত ক্যালোরি ট্রাইগ্লিসারাইডে রূপান্তরিত হয়ে চর্বি কোষ এবং যকৃতে জমা থাকে।
কেন ট্রাইগ্লিসারাইড বিপজ্জনক?
আমরা প্রতিদিন ভাত, মিষ্টি, ফাস্টফুড, কেক, বিস্কুট ইত্যাদির মাধ্যমে যে পরিমাণ ক্যালোরি গ্রহণ করি, তার বেশিরভাগই শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে খরচ হয় না। এই অতিরিক্ত ক্যালোরি লিভারে ট্রাইগ্লিসারাইড হিসেবে জমা হতে থাকে, যার ফলে “ফ্যাটি লিভার” হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তা এলডিএল কণার মাধ্যমে ধমনীর দেয়ালে প্লাক বা আস্তরণ তৈরি করে, যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত ট্রাইগ্লিসারাইড ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) কমাতেও ভূমিকা রাখে।
ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমিত মাত্রা কত?
- স্বাভাবিক (Normal): ১৫০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারের (mg/dL) কম।
- সীমান্তবর্তী উচ্চ (Borderline High): ১৫০ থেকে ১৯৯ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার।
- উচ্চ (High): ২০০ থেকে ৪৯৯ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার। এই পর্যায়ে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।
- অত্যধিক উচ্চ (Very High): ৫০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারের বেশি। এক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ (Pancreatitis) এবং মারাত্মক লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণে যা খাবেন এবং যা এড়িয়ে চলবেন
কার্যকরী খাবার:
- পানীয়: গ্রিন টি ও পর্যাপ্ত পানি।
- মসলা: মেথি, ফ্ল্যাক্সসিড (তিসি), রসুন, পেঁয়াজ এবং পরিমিত পরিমাণে কালিজিরা।
- শাকসবজি: পালং শাক, লাল শাক, পুঁই শাক, বরবটি, করলা, লাউ, শসা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, বেগুন ইত্যাদি।
- ফল (সীমিত পরিমাণে): কমলা, মাল্টা, আপেল, পেয়ারা, জাম ও বেরি জাতীয় ফল। আম ও কলায় চিনির পরিমাণ বেশি থাকায় পরিমিত খেতে হবে।
- প্রোটিন: তৈলাক্ত মাছ (ইলিশ, রুই, কাতলা), নদীর ছোট মাছ, চামড়া ছাড়া মুরগির মাংস, ডিমের সাদা অংশ, বিভিন্ন ধরনের ডাল ও ছোলা। মাছ তেলে না ভেজে সেদ্ধ, ঝোল বা গ্রিল করে খাওয়া উত্তম।
- শস্য: লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি, ওটস ও ব্রাউন ব্রেড (সীমিত পরিমাণে)।
- স্বাস্থ্যকর তেল: রান্নায় সীমিত পরিমাণে অলিভ অয়েল বা সরিষার তেল ব্যবহার করুন। দিনে মোট তেলের পরিমাণ ২-৩ চামচের বেশি হওয়া উচিত নয়।
- বাদাম: আখরোট ও কাঠবাদাম পরিমিত পরিমাণে খেতে পারেন।
যেসব খাবার এড়িয়ে চলবেন:
- ভাজা-পোড়া ও ফাস্টফুড: সিঙ্গাড়া, সমুচা, পুরি, পরোটা, পিৎজা, বার্গার।
- চর্বিযুক্ত খাবার: ঘি, মাখন, ডালডা, চানাচুর এবং লাল মাংস (গরু, খাসি)।
- চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয়: মিষ্টি, আইসক্রিম, কেক, বিস্কুট, চকলেট এবং কোমল পানীয়।
- অতিরিক্ত শর্করা: সাদা চালের ভাত, ময়দার তৈরি নুডলস বা পাস্তা এবং আলু অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- বদভ্যাস: ধূমপান ও মদ্যপান সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে হবে।
জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনুন
- ব্যায়াম: প্রতিদিন ৩০-৪৫ মিনিট দ্রুত হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটার অভ্যাস করুন।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে আনুন।
- পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন রাতে ৬-৮ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
- খাদ্যাভ্যাস: রাতে ঘুমানোর অন্তত ২-৩ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার শেষ করুন।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, শরীরচর্চার মাধ্যমে পেশি গঠন করা জরুরি। কারণ, শরীরে পর্যাপ্ত মাংসপেশি থাকলে অতিরিক্ত শর্করা রক্ত থেকে শোষিত হয়ে পেশিতে জমা হয়, যা লিভারে চর্বি জমার ঝুঁকি কমায়।
সর্বোপরি, রোগাক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসার পেছনে ছোটার চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। তাই সচেতন হন এবং বছরে একবার লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষার মাধ্যমে নিজের শরীরকে সুরক্ষিত রাখুন।



