ইসলাম ধর্মবিশ্লেষণসংগৃহীত সংবাদ

নারীদের পর্নোগ্রাফির আসক্তি: পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের এক নীরব কারণ

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: পর্নোগ্রাফির সর্বনাশা আসক্তিকে সাধারণত পুরুষদের সমস্যা হিসেবে দেখা হলেও সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও সামাজিক বাস্তবতা এক ভিন্ন এবং আরও উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, পর্নোগ্রাফিতে আসক্তদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী। নারীদের মধ্যে এই আসক্তির ভয়াবহতা এবং এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি সামাজিকভাবে প্রায়শই অনালোচিত ও উপেক্ষিত থেকে যায়।

দৃষ্টি সংযমের ইসলামি নির্দেশনা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

ইসলামে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণের (হিফজুল বসর) বিধান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। যদিও এই নির্দেশনাটি পুরুষদের ক্ষেত্রেই বেশি আলোচিত হয়, নারীদের জন্যও পরপুরুষের প্রতি দৃষ্টিপাত থেকে বিরত থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, একদিন তিনি ও মায়মুনা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট উপস্থিত ছিলেন, এমন সময় অন্ধ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) সেখানে আসেন। নবী (সা.) তখন তাঁর স্ত্রীদের পর্দা করতে বললে উম্মে সালামা (রা.) আরজ করেন, “হে আল্লাহর রাসূল! তিনি তো অন্ধ, তিনি আমাদের দেখতে পাচ্ছেন না।” উত্তরে নবী (সা.) বলেন, “তোমরা দুজনও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছ না?” (মুসনাদে আহমদ, জামে তিরমিযী, সুনানে আবু দাউদ)। এই হাদিসটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, নারীদেরও দৃষ্টি সংযম করা এবং ফিতনা থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য।

পর্নোগ্রাফির আসক্তি যেভাবে ধ্বংস করছে দাম্পত্য জীবন

নারীদের পর্নোগ্রাফির আসক্তি কেবল ব্যক্তিগত পাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি বহু দাম্পত্য সম্পর্ক ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব অত্যন্ত জটিল এবং সুদূরপ্রসারী:

  • অবাস্তব প্রত্যাশা তৈরি: পর্নোগ্রাফিতে প্রদর্শিত অবাস্তব, কৃত্রিম এবং মেডিসিন-নির্ভর যৌন কর্মকাণ্ড দেখে একজন নারীর মনে তার স্বামীর সম্পর্কে এক ধরনের অতৃপ্তিকর ও অবাস্তব প্রত্যাশা তৈরি হয়। তিনি ভুলে যান যে, পর্দার ঐ দৃশ্যগুলো সম্পাদনা, ক্যামেরা এবং বিভিন্ন উপকরণের কারসাজি মাত্র, যা একজন সাধারণ পুরুষের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে অনুকরণ করা অসম্ভব।
  • স্বামীর আত্মবিশ্বাসে আঘাত: স্ত্রীর মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশা পূরণ করতে না পেরে স্বামী অক্ষমতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ক্রমাগত এই মানসিক চাপের ফলে তার আত্মবিশ্বাস মারাত্মকভাবে কমে যায় এবং তিনি মনস্তাত্ত্বিক যৌন অক্ষমতায় (Psychosexual Dysfunction) ভুগতে শুরু করেন। যা মূলত তার শারীরিক অক্ষমতা নয়, বরং স্ত্রীর আচরণই তাকে অক্ষম করে তোলে।
  • ভুল চিকিৎসার ফাঁদ: এই পর্যায়ে ভুক্তভোগী স্বামী দিশেহারা হয়ে প্রায়শই অপচিকিৎসা বা হারবাল চিকিৎসার নামে অসাধু ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হন। এসব এলোপাতাড়ি ওষুধ সেবনে সাময়িক ফল পাওয়া গেলেও তা দীর্ঘমেয়াদে পুরুষের স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় এবং একসময় তিনি ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন।

সামাজিক অবক্ষয়ে এর ভূমিকা

দাম্পত্য জীবনের এই সংকট পরবর্তীতে আরও গভীর সামাজিক অবক্ষয়ের জন্ম দেয়।

  • পারিবারিক অশান্তি: অতৃপ্ত স্ত্রী ক্রমশ খিটখিটে মেজাজের হয়ে ওঠেন, সংসারের প্রতি উদাসীন হন এবং স্বামীর প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ ও যত্ন কমে যায়।
  • পরকীয়া ও অবিশ্বস্ততা: এই মানসিক শূন্যতা থেকে অনেক ক্ষেত্রে পরকীয়ার মতো ধ্বংসাত্মক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়।
  • পুরুষবিদ্বেষ ও নারীবাদ: অনেক সময় আসক্ত নারী তার অনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে স্বামীকে বাধা হিসেবে গণ্য করে। পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করে সে এক ধরনের পুরুষবিদ্বেষী মানসিকতা ধারণ করে এবং নিজের লাগামহীন জীবনযাত্রাকে বৈধতা দিতে কথিত ‘নারীর মুক্তি’ বা উগ্র নারীবাদী চিন্তাধারার আশ্রয় নেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি একটি ‘চেইন অফ কমান্ড’-এর মতো কাজ করে, যেখানে একটি ব্যক্তিগত অবক্ষয় পারিবারিক ও সামাজিক সংকটকে উস্কে দেয়। এছাড়া নারীদের মধ্যে সমকামিতার মতো বিকৃত চর্চার প্রসারেও পর্নোগ্রাফি বড় ভূমিকা রাখছে।

অতএব, নারীদের পর্নোগ্রাফির আসক্তিকে একটি বিচ্ছিন্ন বা ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি একটি নীরব ঘাতক, যা পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি দৃষ্টি সংযমের গুরুত্ব নারী-পুরুষ উভয়েরই অনুধাবন করা অপরিহার্য।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button